অবুঝ সময়ের সবুজ গল্প
একবার একটা শালিকের বাচ্চা ধরে এনেছিলাম
মনে আছে- নিজের নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে
পাখির বাচ্চা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম খুব
ঘাসফড়িং এর খুঁজে কার্তিকের কুয়াশা ভেঁজা ভোরে
আলপথ ধরে হেঁটেছি ; ক্লান্তিহীন
দু’ধারে কৃষকের ঘামে ভেজা ধানের
স্বপ্নময় সোনালি সংসার মাড়িয়ে ধরেছি কতো রঙিন ফড়িং
মাঝে মাঝে চোখে পড়তো শহর থেকে আসা
জালালি কবুতর কিংবা
কাকতাড়ুয়ার মাথায় বসে থাকা কাকদের প্রেম…
বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়েই শালিক ছানার সাথে কাটছিলো দুরন্ত সময়…
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষের অনুভূতি নিয়ে
যখন আমি আবেগাপ্লুত, ঠিক তখনই বিপত্তিটা ঘটলো
বাচ্চাটা কিছুই খাচ্ছে না,
অতি যত্নে মুখে দেওয়া খাবার বারবার উগলে ফেলছে
যতো সময় যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছে
তার চিন্তায় রঙিন মুহূর্তগুলো যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে আমার
খুব মনে আছে- আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র
ক্লাসেও মন বসাতে পারছিলাম না কিছুতেই
বারবার চোখে ভাসছে বাচ্চাটার
নরম পালক আর অসহায় জলজ চোখ
মনেমনে ভাবলাম বাড়ি ফিরে বিকেলে বাচ্চাটাকে
চমক আলী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো
স্কুল থেকে ফিরে দেখি খাঁচা শূন্য, বাচ্চাটা নেই
গভীর উৎকন্ঠায় শঙ্কিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করলে
মায়ের নির্বিকার উত্তর- ছেড়ে দিয়েছি
রাগ আর কষ্টের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়
আমার পায়ের তলার মাটি যেন কাঁপছে
ঘাটের পারে বসে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম মনে নেই
সন্ধ্যায় ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ঘরে ফিরলে
মা অনেকভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন
অভিমানী আমি কোনও ভাবে বুঝতে চাই নি
আমার একটাই দাবি- পাখির বাচ্চা চাই
শেষপর্যন্ত মা বললেন- বাবারে
মা ছাড়া বাচ্চা আর বাচ্চা ছাড়া মা থাকত পারে না
হোক সে মানুষ অথবা অন্যকোনও প্রাণী
ধর্- যদি কেউ তোকে ধরে নিয়ে যায়, তবে কি
তুই সেই অপরিচিত মানুষের ঘরে থাকতে পারবি?
অথবা তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো?
মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম তখন…
.
মানুষ এবং ধার্মিক
ঘর থেকে বের হলেই বেশিরভাগ সময়
ধার্মিকদের সাথে দেখা হয়
দেখা হয় একেকজন পাক্কা ব্যবসায়ীর সাথে
কাজের জায়গায়, চায়ের আড্ডায় কিংবা
যেকোনও অনুষ্ঠানে।
অথচ কি আশ্চর্য!
খুব কম সময়ই দেখা হয় মানুষের সাথে…
শুধু ধর্মগ্রন্থ পড়ে ধার্মিক হওয়া যায় না
ধার্মিক হওয়ার আগে মানুষ হতে হয়
দ্বিন আর ধর্মের পার্থক্য যারা বুঝে না
তারা কিভাবে বুঝবে মানবতাই যে মানবধর্ম
.
আত্মকথন
হাততালি আর বাহ্ বা কুড়াতে আসিনি
এসেছি চোয়াল ভেঙে দিতে…
অথবা বলতে পারো- জ্বলতে এবং জ্বালাতে এসেছি
কবিতায় প্রেম আমার ব্যক্তিগত কিছু নয়
দায়বদ্ধতা আমাকে প্রায়ই তাড়িয়ে বেড়ায়
নতুন কোনও বিদ্রোহীশব্দ খুঁজে পাই না বলে
প্রিয় কবি নজরুলকে হিংসাও হয় খুব।
পদকের জন্য আমার কোনও পদক্ষেপ নেই
এ আমার হৃদয় পোড়ার করুণ শব্দগুচ্ছ
কিংবা নিখাদ ভালোবাসার নির্মল আকুতি
কেননা আমি নিতে আসিনি, দিতে এসেছি…
সাহিত্যব্যবসায়ীদের প্রতি ঘৃণা বেড়েই চলছে…
তারপরও আশার আলোয় স্নাত হই, স্বপ্নে ভাসি,
সুস্থ সাহিত্যের বিজয় অনিবার্য।
.
আমি নয় আপনারাই দায়ী
আমার কলম থেকে একটি শব্দও বের হয় নি কবি খ্যাতির জন্য
বলতে গেলে সাহিত্য কাননে আমি এক নবাগত শব্দচাষি
একটি গাছও ঠিকমতো লাগাতে পারি নি হয় তো,
এখনও মাটি খুঁড়াখুঁড়িতেই রয়ে গেছি…
আত্মমগ্নতা কিংবা খেয়ালের বসে বের হয়ে আসা কিছু অগোছালো শব্দমালাকে কবিতা আখ্যা দিয়ে
আপনারাই আমাকে কবি করে তুললেন
আর এজন্য আপনারাই দায়ী, প্রিয় পাঠক মহোদয়
বলতে পারি আপনাদের কাছে এ আমার ভালোবাসার ঋণ…
অথচ এই আমি অতি সাধারণ আপনাদেরই একজন,
নিছক পাঠক হতে চেয়েছিলাম
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পাঠ করতাম মূল্যবান যত লেখা, কিংবা
নীরবে পিছনের সারিতে বসে থাকতাম
কাব্যজলসা অথবা সাহিত্য আড্ডায়
সকলের প্রিয়ভাজন আর ভালোবাসাস্নাত ছিলাম
সামনেপিছনে কারো কোনও অভিযোগ ছিল না
নির্ঝঞ্ঝাট আর ভালো সময় ছিল আমার
এখন আপনারাই টেনে নিয়ে যান সামনের সারি অথবা মঞ্চে
আর কেউকেউ অযাচিত বলাবলি করেন পিছনে
কিন্তু আমার কী করার আছে বলুন
বিবেককে তো আর জলাঞ্জলি দিতে পারি না
আমার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্ব
আমাকে বারবার খুঁচা দিতে থাকে
আর সেই থেকে এই কলরব, এই বিদ্রোহ
কেননা আমি তো বিদ্রোহী নজরুলের উত্তরাধিকারী একজন…
.
ডাস্টবিন
ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিন খোঁজছিলাম
কোথাও একটা ডাস্টবিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না
ময়লা হাতে নিয়ে যখন হতাশ আমি
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার চারপাশে
কতগুলো ডাস্টবিন ঘুরাঘুরি করছে
রক্ত-মাংসের ডাস্টবিন ময়লাভরতি
হিংসা আর পরনিন্দায় ঠাসা নোংরা হৃদয়
দুর্গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসছিলো
নাক চেপে কোনরকমে ফিরে এসেছি…