বাংলাদেশের বলিষ্ঠ এক কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান প্রয়াত হয়েছেন ১৬ আগস্ট। উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলার মতো তাঁর আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস ধবল জ্যোৎস্না। তাঁর গদ্যও ছিল ধবল জ্যোৎস্নার মতো। এই লেখককে নিয়ে এ সংখ্যার প্রচ্ছদ আয়োজন।
মৃত্যুর আগে ১৯৭১ সালের আত্মস্মৃতি লিখে গেছেন রিজিয়া রহমান। অপ্রকাশিত সেই পাণ্ডুলিপি থেকে এখানে ছাপা হলো তাঁর ২৫ ও ২৬ মার্চের আত্মস্মৃতির নির্বাচিত অংশ।
২৫ মার্চের রাতটি পৃথিবীর আহ্নিক গতির নিয়মানুবর্তিতা জেনেই বিদায় নিতে থাকে। রাতের শরীরে ফুটে উঠে ভোরের আভাস। মসজিদ থেকেই কেঁপে কেঁপে ভেসে আসে ফজরের আজান। আমাদের ঘরগুলোতে তবু কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে অন্ধকার। পর্দা টানা ঘরে দিন-রাতের পার্থক্য বুঝে উঠি না আমরা। সেই ভোরে, বাড়ির পেছনের ঝাপড়ানো শিরীষ গাছে পাখিরা ডেকে উঠেছিল কি না জানি না, সেদিন কি শহরের হতভম্ব কাকেরা কা-কা করে ডেকে ভোরের জানান দিয়েছিল? অথবা পথের বেওয়ারিশ কুকুরেরা ফুটপাতের আনাচ-কানাচে ডাস্টবিনের পাশে মরা মানুষের লাশের কাছে অসহায় ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করেছিল? কিছুই জানতে পারিনি আমরা। আমাদের চেনতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল দুর্বোধ শব্দের আতঙ্ক। সেদিন গোটা ঢাকা শহরটি হয়তো মৃতপুরীর মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য দূরে এবং কাছে তখনো থেকে থেকে ধমক দিয়ে চলেছিল মারণাস্ত্রের কঠিন শব্দ।
তখনো আমরা ধারণাই করতে পারিনি, কী ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটে গেছে এই শহরে (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা—স্বজনের মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো অনেকেই বহন করছেন)। সে সময়ের স্মৃতি এখনো দুঃস্বপ্নের মতো আমাদের তাড়িত করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাতে অথবা পরবর্তী ৯ মাসের যেকোনো সময়ে আমরাও তো পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার শিকার হতে পারতাম, অথবা একাত্তরে ইজ্জত হারিয়ে বীরাঙ্গনার দুঃসহ সম্ভ্রমহীন জীবন কাটাতে পারতাম। দুঃখের সঙ্গেই স্মরণ করি সেই দিনটিকে—স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর, যে দিনটিতে জাতির কান্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ষিত নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছিলেন, বীরাঙ্গনা অর্থাৎ বীর নারী সম্বোধনে সম্মান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁদের অবদানের উল্লেখ করেছিলেন। তিনি সেদিন এই দুর্ভাগা নারীদের অবস্থান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একই সারিতে ঘোষণা করেছিলেন।
বলতে দ্বিধা নেই, আমরা অকৃতজ্ঞ এবং কুসংস্কারের শিকলে বন্দী স্মৃতিভ্রষ্ট এক জাতি, মহান নেতার মহৎ সেই উদ্দেশ্যকে আমরা গুরুত্ব দিতে পারিনি। যে কারণে ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানসূচক খেতাবপ্রাপ্ত বীর নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঘরে–বাইরে, পরিবারে, সমাজে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি হয়ে গেছে যুদ্ধে দখলকার সৈনিক ও যুদ্ধাপরাধী দেশদ্রোহীদের দ্বারা নির্যাতিত-ধর্ষিত নারীদের পরিচয়ের সংজ্ঞার মতো। দেশ ও সমাজ কখনোই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেনি, বরং তাঁদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে অপমান, লাঞ্ছনা ও অপবাদ। পরিবারও তাঁদের পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়েছে (নিশ্চয় প্রিয়ভাষিণীর মতো সাহসী হওয়ার পরিবেশ ও প্রেরণার সুযোগ অনেকেই পাননি)।
বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসেও এমন অনেক নারীর অপমানিত জীবনগাথা আজও নীরবে অশ্রুপাত করে চলেছে। পর্তুগিজ-হার্মাদ বা মগ জলদস্যুদের হানায় যে বাঙালি নারীরা ধর্ষিত নির্যাতিত হতেন, সমাজে তাঁরা হয়ে যেতেন অসতী, কুলটা, কলঙ্কিনী, অস্পৃশ্য। ‘মগা-নারী’ আখ্যায় তাঁদের একঘরে করে দেওয়া হতো। এই হতভাগিনীরা স্বাভাবিক সমাজজীবন হারিয়ে দুঃখ-বেদনায়, অভাবে-লাঞ্ছনায় অপমানিত জীবনযাপন করতেন, লোকালয় থেকে দূরে।
কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে একটি গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরেও আমাদের মানসিকতায় মধ্যযুগীয় সেই কুসংস্কারকে আমরা নির্মূল করতে পারিনি। তাই আমাদের সেই বীর নারীরা ‘বীরাঙ্গনা’র প্রকৃত সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে গেছেন এবং এখনো করছেন। হয়তো সেই কারণেই হানাদারের হামলায় বীরাঙ্গনা হতে হয়নি বলে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করেছি।
২৫ মার্চের সেই রাত থেকে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়টি দেশের কিশোরী–তরুণী কিংবা যুবতী অথবা মধ্যবয়সী নারীদের জন্য ছিল ধর্ষিত হওয়ার আশঙ্কায় ভরা, যা ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। ২৬ মার্চের সেই ভৌতিক ভোরটিতেও গণহত্যা বা নারীর প্রতি নির্যাতিত নৃশংস নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ।