বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না

রাজধানীর কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেতন পরিশোধ করেছে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি আর বেতন-ভাতা দেয়নি। চিকিৎসক, শিক্ষক, নার্স ও স্ব্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষের কাছে বেতনের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তারা করোনা পরিস্থিতির কারণে বেতন-ভাতা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থ্থায় সেখানে কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ স্ব্বাস্থ্থ্যকর্মীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সচিব শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বেতন ও হাসপাতালে রোগী ভর্তি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া অর্থই আমাদের আয়ের উৎস। এই আয় থেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ের সব উৎস বন্ধ থাকায় বেতন-ভাতা পরিশোধে একটু সমস্যা হচ্ছে।

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমা আশ্বস্ত করেছেন, পরিস্থিতি স্ব্বাভাবিক হলেই সবার বেতন-ভাতা পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু অনেকে তা মানতে চান না। এরপরও পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছুসংখ্যক কর্মীকে বেতন দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু কর্মীকে বেতন দেওয়া হবে। সুতরাং বেতন না দেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়।

একইভাবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও এপ্রিল মাসের বেতন দেওয়া হয়নি। মার্চে ৫০ শতাংশ বেতন দেওয়া হয়। তিন ভাগে ভাগ করে ওই বেতন দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক সমকালকে বলেন, চিকিৎসক, নার্স ও স্ব্বাস্থ্যকর্মীরা বেতনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তারা অপারগতা প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবদুল হাই চৌধুরী সমকালকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে রোগী কমে গেছে। শিক্ষার্থীরাও বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন না। এ অবস্থ্থায় আয়ের উৎসগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সংকট আরও বাড়বে। পরিস্থিতি স্ব্বাভাবিক হলে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে।

করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে না। দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট ৭০টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টির তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী দেখা যায়, ২০টি প্রতিষ্ঠান এক থেকে চার মাস ধরে বেতন দিচ্ছে না। নয়টি প্রতিষ্ঠান আংশিক দিয়েছে। নয়টি বেতন দিলেও বোনাস দেয়নি। আর ১৬টি বেতন-বোনাস পুরোপুরি পরিশোধ করেছে। এর বাইরে আরও যে ১৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোতেও এক থেকে চার মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া। অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স ও স্ব্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান করোনা সংকটের আগে থেকেই বেতন দিচ্ছিল না। আর কিছু প্রতিষ্ঠান সংকট শুরুর পর বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের কেউ ৫০ শতাংশ, কেউ ৭০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিন কিস্তিতে বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে। অনেকে বেতন দিলেও ঈদ বোনাস এখনও দেয়নি। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শুধু পুরো বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে।

এদিকে বেতন-ভাতা না পেয়ে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। ছোট পদের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। তারা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতা না দেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমএ মবিন খান। তিনি সমকালকে বলেন, সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ তাদের সংগঠনের সদস্য নয়। তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে। অন্যদের বিষয়ে তার জানা নেই।

কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে এমএ মবিন খান বলেন, যতটুকু জেনেছি, তারা বেতন-ভাতা দেওয়া শুরু করেছে। ঈদের আগেই হয়তো পরিশোধ করে দেবে। তবে সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।

চিকিৎসক, নার্স ও স্ব্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি সমকালকে বলেন, এটি নিন্দনীয় বিষয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক চিকিৎসক তার কাছে ফোন করে বেতন-ভাতা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। বেতন না পেয়ে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দুর্যোগ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর মালিকরা দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া কর্মীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করছেন। তিনি দ্রুত বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সংশ্নিষ্টদের প্রতি তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে নিরসন করবেন। এরপরও বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে পরবর্তী সময়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *