রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারাকে আরও সম্পৃক্ত করার প্রতিশ্রুতি আলোচকদের

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরে ২৯ জুন স্থানীয় কংগ্রেসম্যান, জনপ্রতিনিধি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, মনোবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, অভিনেত্রী, মডেল, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গসহ ফিলাডেলফিয়ায় বসবাসরত বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হল “বিশ্ব শরণার্থী দিবস: রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থীদের সমসাময়িক হুমকিসমূহ (World Refugee Day: Contemporary Challenges of the Protracted Refugee Situation Including the Rohingyas)” শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার।

ফিলাডেলফিয়ারা প্রবাসী তরুন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী মো: লুৎফর রহমান হিমু’র প্রতিষ্ঠান ব্রিটস্ গ্লোবাল ফাউন্ডেশন এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। বিশেষ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের মন্ত্রী নিলা টেইলর, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন এর সিনিয়র পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার মিজ ডানা সিলেইম্যান, বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ড. ওচিমা পিটম্যানা, মানবাধিকার প্রবক্তা জোসেফ হ্যারিস, ফিলাডেলফিয়ার ৬০নং ওয়ার্ডের কমিটিম্যান গ্রেক থম্পসন, ফ্যাশান ডিজাইনার ও আর্টস্ অর্গানাইজার ভ্যানি তাওসাইন্যান্ট, সঙ্গীত শিল্পী, মিজ্ টিন ইন্টারন্যাশনাল বিউটি ও মিজ্ ভারত, সুজান কচ, আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ফটোগ্রাফার ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার উলিসি টাওসাইনটিস, অভিনেত্রী, মডেল ও মানবাধিকার কর্মী ইভি ডমিনিকুই, শিশুতোষ বই এর লেখক ও সঙ্গীত প্রযোজক আলবার্ট রিড, সাউথ সুদানের সাবেক শরণার্থী বর্তমান মানবাধিকার কর্মী নায়ামাল টুডিয়াল ও বাংলাদেশের আরটিভির সিইও আশিক রহমান। অনুষ্ঠানটির বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিকের উপস্থিতি।

 

সেমিনারটিতে বক্তব্য প্রদানকালে রাষ্ট্রদূত মাসুদ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মূল চ্যালেঞ্জসমূহ বিশেষ করে সঙ্কট সমাধানের মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের ফলে বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিন্যাসের যে ক্ষতি হয়েছে তা তুলে ধরেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদারতা প্রদর্শন করেছেন এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদার ও কার্যকরভাবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তিনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে এর দায়বদ্ধতার মুখোমুখি করা, মূল কারণ খুজে বের করে এর সমাধান করা, রাখাইন প্রদেশে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেফ জোন গড়ে তোলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। এক্ষেত্রে জাতিসংঘে ভূমিকা রাখা, রোহিঙ্গাদের জন্য একক বৃহত্তম মানবিক সহায়তা প্রদান, মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ ৫জন মিলিটারি কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, সহিংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ-এ রেজুলেশন গ্রহণসহ নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।

উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের মুলধারার জন প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজ আপনারা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে যে একাত্বতা দেখালেন তা সত্যিই বিরল। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে আরও মানবিক ও রাজনৈতিক সহায়তা, দায়বদ্ধতা নিরূপনে চাপ প্রয়োগ, আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আখ্যাদান ইত্যাদি বিষয়ে আরও ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে স্থানীয় কংগ্রেসম্যানগণ যাতে পদক্ষেপ নেন সে অনুরোধ জানান রাষ্ট্রদূত মাসুদ। এছাড়া এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সহায়তা কামনা করেন।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের পদক্ষেপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে আসছেন তা অবশ্যই ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। রাষ্ট্রদূত এটিকে পাবলিক ডিপ্লোম্যাচি আখ্যা দিয়ে ফিলাডেলফিয়ার আয়োজক ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি প্রত্যাশা করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে রেহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রবাসীগণ এভাবে এগিয়ে আসবেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইটসিআর) এর সিনিয়র পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার মিজ ডানা সিলেইম্যান বিশ্বের শরণার্থী সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি ও সমসাময়িক চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরেন। ইউএনএইচসিআর শরাণার্থীদের জন্য যে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে করে তা উল্লেখ করেন তিনি। শরণার্থী যে কোনো দেশের জন্যই একটি সমস্যা বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে শরনার্থী সঙ্কট মারাত্বক সমস্যা সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেন সিলেইম্যান। রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে এর মূল কারণ অনুসন্ধানের উপর সর্বোচ্চ জোর দেন ইউএনএইচসিআর এর এই প্রতিনিধি।

সেমিনারে প্রদত্ত বক্তব্যে মূলধারার জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে তারা বলেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দানের ক্ষেত্রে যে উদারতা দেখিয়েছে তা বিশ্বে বিরল। রোহিঙ্গাসহ দীর্ঘমেয়াদী শরণার্থী সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান বক্তাগণ। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র যাতে আরও ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে তারা জোর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

সঙ্গীত শিল্পী, মডেল, মিজ্ টিন ইন্টারন্যাশনাল বিউটি ও মিজ্ ভারত নিউইয়র্ক সুজান কচ রোহিঙ্গা সঙ্কটের আদ্যপান্ত তুলে ধরেন। এই কিশোরীর সাবলিল ও হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা সকলেরই দৃষ্টি কাড়ে।

আরটিভির সিইও আশিক রহমান রোহিঙ্গা সঙ্কটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়োকোচিত ভূমিকা তুলে ধরার পাশাপাশি আরটিভির প্রযোজনায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্মিত ‘জন্মভূমি’ সিনেমার বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

ব্রিটস্ গ্লোবাল ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মো: লুৎফর রহমান হিমু রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের উদারতার নানা উদাহরণ তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠানে স্বত:স্ফুর্তভাবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

সেমিনারটির মডারেটর ছিলেন ফিলাডেলফিয়ার বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও উপস্থাপক স্টিভেন বি প্যাক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *