জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে জেনারেল আজিজের স্মৃতিচারন

ইশতিয়াক রূপু নিউইয়র্ক থেকেঃ
.


বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে বহতা নদী সুরমার পারে দ্বিতল কাঠের তৈরী বাংলায়। পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান তখন সুনামগন্জ মহকুমার প্রশাসক। প্রাথমিক লেখা পড়া শুরু সুনামগন্জে। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনেরপ্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফলতা পেয়ে রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে জেন্টলম্যান ক্যাডেট নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতীয় সামরিক একাডেমী রাজকীয় বাহিনীতে ১৯৪০ সালে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওসমানী মেজর পদে উন্নীত হয়ে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়করূপে যুদ্ধ করেন।ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের ৭ অক্টোবর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পরদিনই লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন।

১৯৪৮ সালে তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করে ১৯৪৯ সালে থেকে চীফ অব দি জেনারেল স্টাফের সহকারি নিয়োগ করা হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ওসমানী সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শাখাতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। এরপরই আর্মি হেডকোয়ার্টারে জেনারেল স্টাফ ও মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর নিযুক্ত হন।১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তাঁর এ পদোন্নতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়।

১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিলে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পর পরই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন এবং জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ওসমানী ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং নতুন মন্ত্রিসভায় ডাক, তার ও টেলিফোন, যোগাযোগ, জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে সংসদ-সদস্য পদ এবং দলের সদস্য পদ ত্যাগ করেন ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় জনতা পার্টি নামে দলের সভাপতি হিসাবে রাস্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৮১ সালে পুনরায় জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রার্থী হন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।জেনারেল ওসমানী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে মূল্যবান স্মৃতি চারন করেন দুই জন বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব। একজন হলেন জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে ক্যাপটেইন পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুর সেনানিবাসে যোগ দেন।পরবর্তিতে জেনারেল আজীজ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে সিলেটকে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে সিলেট চলে আসেন। জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তমের স্মৃতিচারনে সেনা নায়ক ওসমানী দুভাবে এসেছেন। যার সূচনা হয় পাকিস্তানে সেনা বাহিনী থাকা অবস্থায় তৎকালীন সময়ে বাঙ্গালী অফিসার হন অথবা নন কমিশন্ড সাধারন সৈনিক সবার য়ে কোন ধরনের বিপদ আপদে সর্বশেষ ভরসার স্থল ছিলেন কর্নেল ওসমানী। থাকতেন রাওয়ালপিন্ডির মিলিটারী ক্যান্টনমেন্টের অফিসার মেসে। সেটা ১৯৬৬ সালের দিকে যখন জেনারেল আজিজ কাকুলে সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত। জেনারেল ওসমানী তখন পুরো দস্থর একজন প্রফেশনাল বড় সামরিক কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীর সব ধরনের নিয়ম পালনে কোন ছাড় নেই।তবে একটি বিষয়ে বড়ই দুর্বল ছিলেন।স্বদেশ প্রেম।মানে যে মাটিতে জন্ম হলো, বড় হলেন সেই মাটির ছোঁয়ায় বেড়ে উঠা কাছের কিম্বা নিকট দুরের মানুষদের প্রতি ছিলো বিশেষ এক টান এবং ভালবাসা।বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তার দেশে যাওয়া প্রয়োজন।কিন্তু ছুটি পাচ্ছেন না। কারো টিকেটের পয়সা কম হয়ে গেছে তেমনি অসংখ্য বাঙ্গালী অফিসার কিম্বা জওয়ানদের সব ধরনে সহায়তায় সব সময় এগিয়ে আসতে জেনারেল ওসমানী। জেনারেল আজীজের শেষ কথাটি ছিলো এভাবে তৎকালীন সময়ে সারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এমন কোন বাঙ্গালী সামরিক ব্যাক্তিত্ব পাওয়া যাবে না যিনি সরাসরি নয়তো দূর থেকে জেনারেল ওসমানীর সাহায্য পান নি।

তারপর সুরমায় জল অনেক গড়ালো।এলো মুক্তিযুদ্ধ।১৯৭১ সালের ১৯ শে মার্চ জয়দেবপুর সেনানিবাসে ক্যাপটেইন হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় জেনারেল আজীজ মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময়ে বাঙ্গালী সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লার কথা স্মৃতি চারনে উল্লেখ করেন।

৩রা এপ্রিল এক প্লাটুন বাঙ্গালী সৈন্য নিয়ে সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হন জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে। সিলেট এসে সিলেটকে মুক্তাঞ্চল হিসাবে ঘোষনা দেবার সিদ্ধান্ত এবং পরামর্শে আরো যুক্ত ছিলেন আরেক জন সিলেটি সামরিক কর্মকর্তা এবং মুক্তিযাদ্ধা জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, যিনি ১৯৭১ সালে মেজর হিসাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। জয়দেবপুর ছেড়ে আসবার সময় যাদের সাহায্য এবং সহায়তার কথা উল্লেখ করেন তাদের মাঝে আছেন বর্তমান মুক্তিযাদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক জনাব হাবিবুল্লাহ, হবিগন্জ নিবাসী শ্রমিক নেতা মোত্তালেব যিনি জয়দেবপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতেন।

সিলেটে আসার পর পাক বাহিনীর সাথে ৭ই এপ্রিল থেকে তুমুল যুদ্ধের সুচনা হয় শহরের প্রধান ঈদগায় ময়দান থেকে,তা চলে টানা দুদিন।৯ই এপ্রিল পাক বাহিনী আর্টিলারীর সাহায্যে প্রচন্ড আক্রমন শুরু করে।সে আক্রমন প্রতিহত করতে করতে জেনারেল আজিজ তার পুরা প্লাটুন নিয়ে সুরমা নদী পারাপারের একমাত্র ব্রিজ কিন ব্রীজের পাশে অবস্থান নেন। সাময়িক ভাবে স্থাপিত গুটি কতক প্রতিরক্ষাবূহু পরিদর্শনে তিনি য়খন সুরমা নদীর পাড়ে মাছিমপুর গ্রামের এক স্কুলে যান। ঠিক তখনই এক পর্যায়ে পিছন থেকে শুনতে পান শতভাগ শুদ্ধ ইংরাজী ভাষায় এবং ভরাট গলায় কে একজন ডেকে বলছেন, হ্যালো ইয়ং ম্যান হোয়ার আর ইউ ডুয়িং হেয়ার। পিছন ফিরে প্রথম বারের মত যার মুখামুখি হলেন তিনি হলেন জেনারেল ওসমানী।বিস্ময়ে খানিক বিমূঢ় হলেও মূহুর্তে নিজেকে সামলিয়ে জেনারেল কে সামরিক কায়দায় স্বাগত জানালেন। শুরু হলো যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা।স্বল্প সময়ের আলোচনা শেষে জেনারেল ওসমানী ক্যাপটেইন( তৎকালীন) আজিজকে নির্দেশ দিলেন সমস্থ সৈন্য এবং রসদ ( যা অবশিষ্ট) নিয়ে অবিলম্বে নদী পার হয়ে মৌলভীবাজারের শেরপুরে চলে যেত। জেনারেল আজিজ কর্নেল ওসমানীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। শেরপুরে অবস্থান কালে পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমল যুদ্ধ হয় এবং জেনারেল আজিজ আহত হয়ে প্রথমে মৌলভীবাজার হাসপাতালে যান। সেখানে কোন ডাক্তার না থাকায় শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট বাগানের হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা কালিন সময়ে উদ্দীন সাহেব নামে একজন পুরাতন চা প্লেন্টার বিভিন্ন সময়ে জেনারেল আজিজের নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন। পরে শ্রীমঙ্গল শহরের পতন হলে জেনারেল আজীজ ভারতের খোয়াই শহরের জি বি হসপিটালে চিকিৎসা নেন। জেনারেল বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,জেনারেল ওসমানীর নিকট যুদ্ধের খবর এতই হালনাগাদ ছিলো যে তিনি জানতেন, আমি( জেনারেল আজীজ) জি বি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে বেড অপ্রতুল থাকায় জেনারেল আজীজ কে মেঝেতে বেড পেতে দেয়া হয়। জেনারেল ওসমানী জনাব আজিজকে দেখতে এসে কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষনিকভাবে জেনারেল আজিজের জন্য বেডের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন।যা দ্রুততম সময়ে তা পালিত হয়। জেনারেল আজিজের শেষ কথাটি ছিলো, ওসমানী সাহেব উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সমরনায়কই শুধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সৎ,নির্ভীক মানবিক ব্যাক্তিত্ব।

প্রসঙ্গ ক্রমে জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে আরো একটি স্মৃতিচারন করলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রতিষ্টিত আইনজীবি শেখ আখতারুল ইসলাম। যিনি জেনারেল ওসমানীকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন।আশির দশকের প্রথমদিকে জেনারেল ওসমানীর সিলেটের নাইওরপুলস্থ বাসার বারান্দায় বসে আলাপ করছেন।মুল বাসা থেকে বাসার গেইট বেশ দূরে। হাঁটা পথে তিন চার মিনিটের পথ।এরই মধ্যে একজন ভিক্ষুক এসে সাহায্য কামনা করলো।ওসমানী সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে কিছু টাকা নিয়ে আসলেন। তখন পাশে বসা আইনজীবী বলে উঠলেন, আমার নিকট দেন আমি দিয়ে আসি। মুহুর্তেই জেনারেল ওসমানী বেশ রাগত্ব স্বরে আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করলেন,উনি (ভিক্ষুক)কি আপনার নিকট সাহায্য চেয়েছেন? আমার নিকট সাহায্য চেয়েছেন, তাই আমারই দায়িত্ব সাহায্যপ্রার্থীর নিকট সাহায্য পৌছে দেয়া।বলেই গট গট করে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে নিজের হাতে ভিক্ষুকের হাতে টাকা গুলি তুলে দিয়ে প্রমান করলেন কাজ যতই ছোট হউক নিজের কাজ নিজেই করা উচিত।

 


ইশতিয়াক রুপু
লেখক, গীতিকার, সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *