যে চিকিৎসা সবচেয়ে ভালো বলেছেন মহানবী

ধর্ম ডেস্কঃ 

রাসুল (সা.)-এর অন্যতম চিকিৎসাপদ্ধতি হলো- হিজামা। তিনি হিজামার উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। উৎসাহিত করেছেন এবং নিজে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। হিজামার ব্যবহার রাসুল (সা.) ও সাহাবাদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

হিজামা হলো- (Wet Cupping) অতি প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতি। হিজামা আরবি শব্দ ‘আল-হাজম’ থেকে এসেছে। যার অর্থ চোষা বা টেনে নেওয়া। আধুনিক পরিভাষায় বলে কাপিং (Cupping)।

হিজামার মাধ্যমে দূষিত রক্ত (Toxin) বের করে নেওয়া হয়। এতে শরীরের মাংসপেশিগুলোতে রক্তপ্রবাহ দ্রুততর হয়। পেশি, চামড়া, ত্বক ও শরীরের ভেতরের অরগানগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শরীর সতেজ ও শক্তিশালী হয়। আরব বিশ্বে হিজামা বেশ জনপ্রিয়। এটি তিন হাজার বছরেরও বেশি পুরনো চিকিৎসাপদ্ধতি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎপত্তি হলেও চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে চীন, ভারত ও আমেরিকায় বহু আগে থেকেই এটি প্রচলিত ছিল। ১৮ শতক থেকে ইউরোপেও এটির প্রচলন রয়েছে।

রাসুল (সা.) যখন হিজামা চিকিৎসা নিয়েছেন

আল্লাহর রাসুল (সা.) তার মাথা ব্যথার জন্য, পায়ে, পিঠে, পিঠের ব্যথার জন্য দুই কাঁধের মাঝখানে, ঘাড়ের দুই রগে ও হাড় মচকে গেলে। (বুখারি, হাদিস : ৫৭০০; নাসায়ি, হাদিস : ২৮৫২; আবুদাউদ, হাদিস : ৩৮৫৯)

অন্য এক হাদিসে আনাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) হিজামা লাগাতেন এবং কারও পারিশ্রমিক কম দিতেন না। (বুখারি, হাদিস : ২২৮০)

হিজামা চিকিৎসায় যেসব উপকারিতা রয়েছে

আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) হিজামা লাগিয়েছেন। আবু তায়বা তাকে হিজামা করেছেন। তিনি তাকে দুই ছা (প্রায় পাঁচ কেজি) খাদ্যদ্রব্য দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তার মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এতে তারা তার ওপর ধার্য করা কর কমিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, তোমরা যেসব পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাও হিজামা সেগুলোর মধ্যে উত্তম ব্যবস্থা অথবা (বলেছেন) এটি তোমাদের ওষুধের মধ্যে অধিক ফলপ্রসূ।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৯৩০)
হাদিসে আছে, জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) অসুস্থ মুকান্নাকে দেখতে যান। এরপর তিনি বলেন, ‘আমি সরবো না, যতক্ষণ না তুমি শিঙা লাগাবে। কেননা আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই এর (হিজামার) মধ্যে নিরাময় রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬৯৭)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রোগমুক্তি তিনটি জিনিসের মধ্যে নিহিত। শিঙা লাগানো, মধু পান করা এবং আগুন দিয়ে গরম দাগ দেওয়ার মধ্যে। তবে আমি আমার উম্মতকে আগুন দিয়ে গরম দাগ দিতে নিষেধ করি। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৮১)

জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.)-এর (পায়ে) যে ব্যথা ছিল, তার জন্য তিনি ইহরাম অবস্থায় হিজামা লাগিয়েছিলেন। (নাসায়ি, হাদিস : ২৮৫২)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মিরাজে যাওয়ার সময় তিনি ফিরিশতাদের যে দলের কাছ দিয়ে অতিক্রম করেন, তারা বলেন, ‘আপনি অবশ্যই হিজামা করাবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬২)

মিরাজের রাত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এই রাতে ফিরিশতাদের যে দলের সম্মুখ দিয়েই তিনি যাচ্ছিলেন, তারা বলেছেন, ‘আপনার উম্মতকে হিজামার নির্দেশ দিন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৭৯; তিরমিজি, হাদিস : ২০৫২)

যেসব অঙ্গে হিজামা করা যায়

আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) তিন স্থানে ঘাড়ের দুটি রগে এবং কাঁধে হিজামা করিয়েছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৬০; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৮৩)

আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) তার মাথায় হিজামা লাগিয়েছিলেন। (বোখারি, হাদিস : ৫৬৯৯)

আবু কাবশাহ আনমারি (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) মাথার মাঝখানে এবং দুই কাঁধের মাঝে হিজামা করতেন এবং বলতেন, যে ব্যক্তি নিজ শরীরের এ অংশে হিজামা করাবে, সে তার কোনো রোগের চিকিৎসা না করালেও কোনো ক্ষতি হবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৫৯; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৮৪)

জাবির (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.)-এর হাড় মচকে গেলে তিনি এজন্য হিজামা করান। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৬৩)

আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) ব্যথার কারণে ইহরাম অবস্থায় তার পায়ের উপরিভাগে হিজামা করিয়েছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৮৩৭)

ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘দাঁতে, মুখে ও গলায় ব্যথা হলে থুতনির নিচে হিজামা লাগালে উপকার পাওয়া যায়, যদি তা সঠিক সময়ে করা হয়। এটা মাথা ও চোয়াল শোধন করে।

ঊরুতে ব্যথা, চুলকানি ও খোসপাঁচড়ার চিকিৎসা হিসেবে বুকের নিচে হিজামা লাগানো উপকারী। এতে পিঠের গেঁটেবাত, অর্শ, গোদ রোগ, খোসপাঁচড়ার প্রতিরোধে সাহায্য করে। (জাদুল মাআদ, হাদিস : ৪/৫৮)

হিজামা চিকিৎসা যেসব রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর

ব্যাক পেইন, উচ্চ রক্তচাপ, পায়ে ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, মাথা ব্যথা (মাইগ্রেন), ঘাড়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, আর্থ্রাইটিজ, জাদু, বাত, ঘুমের ব্যাঘাত, থাইরয়েড ব্যাঘাত, জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তিহীনতা, ত্বকের বর্জ্য পরিষ্কার, অতিরিক্ত স্রাব নিঃসরণ বন্ধ করা, অর্শ, অণ্ডকোষ ফোলা, পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদি প্রতিরোধ হয়।

মাথা ব্যথায় : সালমা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘যখন কেউ রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে মাথা ব্যথার কথা বলত, তখন তিনি তাদের হিজামা করার কথা বলতেন।’ (আবু দাউদ হাদিস : ৩৮৫৮)

জ্ঞান ও স্মৃতিবর্ধক : ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘খালি পেটে হিজামা লাগানো উত্তম। এতে শিফা ও বরকত রয়েছে। এতে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৮৭)

ব্যথা ও জাদু : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘এক ইহুদি নারী রাসুল (সা.)-কে বিষযুক্ত গোশত খেতে দিয়েছিল। তিনি তাকে সংবাদ পাঠিয়ে বললেন, কেন তুমি এ কাজ করলে? নারীটি উত্তরে বলল, যদি তুমি সত্যিই আল্লাহর রাসুল হও, তবে আল্লাহ তোমাকে জানিয়ে দেবেন। আর তুমি যদি তার রাসুল না হও, তবে আমি মানুষকে তোমার থেকে নিরাপদ রাখব! যখন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলেন, তিনি হিজামা ব্যবহার করলেন। একদা ইহরাম অবস্থায় তিনি ভ্রমণে বের হলেন এবং ওই বিষের যন্ত্রণা বোধ করলেন, তখন তিনি হিজামা ব্যবহার করলেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১/৩০৫)

রাসুল (সা.) যখন জাদু দ্বারা আক্রান্ত হন, তখন তিনি মাথায় শিঙা লাগান এবং এটাই সবচেয়ে উত্তম ওষুধ, যদি সঠিকভাবে করা হয়। (জাদুল মাআদ, হাদিস : ৪/১২৫-১২৬)

হিজামা চিকিৎসা কোন সময়ে নেওয়া উত্তম

সাধারণত হিজামার জন্য উত্তম সময় হচ্ছে চান্দ্র মাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখ। আনাস বিন মালেক বলেন, রাসুল (সা.) ঘাড়ের দুই পাশের শিরায় এবং ঘাড়ের কাছাকাছি পিঠের ফোলা অংশে হিজামা করাতেন। তিনি মাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখে হিজামা করাতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২০৫১, ২০৫৩; আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৬১)

যদি অসুস্থতা বা ব্যথা অনুভূত হয়, তবে নিজের সুবিধামতো হিজামা করানো যাবে।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলেন, ‘আল্লাহর বরকত লাভের আশায় তোমরা বৃহস্পতিবার হিজামা করাও এবং বুধ, শুক্র, শনি ও রবিবার বেছে নেওয়া থেকে বিরত থাকো। আর সোম ও মঙ্গলবারে হিজামা করাও।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৮৭)

উল্লেখ্য, রাসুল (সা.) মাসের বিভিন্ন সময়ে হিজামা করেছেন। যেমন হজের সময়, চান্দ্র মাসের প্রথমে। কারণ তিনি খারাপ মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এতে বোঝা যায়, প্রয়োজনে যেকোনো সময় হিজামা করা যায়। তবে অসুস্থ, হায়েজ, অন্তঃসত্ত্বা, ঋতুবতী এবং দুর্বল শরীরের অধিকারীদের শিঙা লাগানো থেকে বিরত থাকা উচিত।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইহরাম অবস্থায় আধ কপালির কারণে তার মাথায় শিঙা লাগান। (বোখারি, হাদিস : ৫৭০১)

ইবনু আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সায়েম অবস্থায় শিঙা লাগিয়েছিলেন। (বোখারি, হাদিস : ৫৬৯৪)

নারীদের হিজামা চিকিৎসা নেওয়া-প্রসঙ্গ

জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, উম্মে সালামা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হিজামা করার জন্য অনুমতি চান। ফলে রাসুল (সা.) তাকে হিজামা লাগিয়ে দিতে আবু তাইবা (রা.)-কে আদেশ দেন। জাবির (রা.) বললেন, আমার মনে হয়, আবু তাইবা তার (উম্মে সালামার) দুধভাই অথবা একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক ছিলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১০৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৮০)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *