নিউমোনিয়ায় বছরে প্রাণ হারাচ্ছে ২০ হাজার শিশু

নিউজ ডেস্কঃ দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে মারা যাচ্ছে প্রায় ২০ হাজার শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছর ৯৩ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর বড় কারণ নিউমোনিয়া। বছরে ২৪ হাজার ৩০০ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এই রোগে। আক্রান্ত শিশুদের ৫২ শতাংশই মারা যাচ্ছে বাড়িতে এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা না পেয়েই। মূলত পরিবেশ দূষণের কারণেই বাড়ছে ফুসফুস সংক্রমণজনিত রোগ নিউমোনিয়ার ঝুঁকি। আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিআরবি) দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী ৮০ হাজারের মত শিশু ভাইরাল নিউমোনিয়ায় ও বিভিন্ন ধরনের রেসপিরেটরি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সীদের শতকরা ২৮ ভাগ মৃত্যুর কারণ এই নিউমোনিয়া।

শীত বাড়তে না বাড়তেই হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুরোগীর সংখ্যা। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে গত কয়েক দিন ধরে বেড়েছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া-বমি, সর্দি-কাঁশিসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। এসবের মধ্যে শিশু রোগির সংখ্যায় বেশি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আবহাওয়াজনিত কারণে বাড়ছে শিশুরোগির সংখ্যা। বেশিরভাগ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।

সকালে ঢাকা শিশু হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে কথা হয় রোকনাসা বেগমের সঙ্গে। তিনি ১১ মাস বয়সি শিশুকে নিয়ে এসেছেন ঠাণ্ডা-জ্বর-বমি ও সর্দি-কাশি নিয়ে। শিশুটির নাম আলী ঈমাম। মায়ের কোলে সে অনবরত কাঁদছে। একই অবস্থা ৫ মাসের শিশু জান্নাতিরও। সে হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না, শুকিয়ে গায়ের চামড়া কিছুটা ঢিলা হয়ে গেছে। অন্য আরেকটি শিশু লানিয়া, বয়স ৭ মাস। শিশুাটর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শব্দ হচ্ছে, মাথার তালুও ওঠা-নামা করছে, লাইনে থাকা এমন অসংখ্য শিশুর একই অবস্থা। এরা সবাই এসেছেন রাজধানীর আশাপাশের এলাকা থেকে। অন্য একজন অভিভাবক আবদুর শায়েকের মা বলেন, গত দুই দিন আগে থেকে জ্বর সর্দি কাঁশি শুরু হয়েছে। এখন কাঁশি অনেক বেশি, শ্বাসকষ্টও আছে, ডাক্তার বলেছে বাচ্চার নিউমোনিয়ার লক্ষণ আছে, শিশু হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বলেছেন তিনি। তাই এখানে নিয়ে এসেছি।

শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই নয়, শীতের শুরুতে আবহাওয়ার কারণে ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে অনেকে। তবে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া নিয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছে শিশুরা। এসডিজি গোলের লক্ষ্য পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫ জনের নিচে কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিউমোনিয়াজনিত শিশু মৃত্যু হার অবশ্যই কমাতে হবে। আশার কথা হলো, নিউমোনিয়া এমন একটি রোগ যা প্রতিরোধ, প্রতিকার ও চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে ৯ লাখ ২২ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এই সংখ্যা মোট শিশুমৃত্যুর ১৬ ভাগ। এদের মধ্যে ৫ ভাগ নবজাতক। তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ১৫ বছরের মধ্যে আগের তুলনায় ৫১ ভাগ শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ২০১১ সালে নিউমোনিয়ায় দেশে ৫ বছরের কম বয়সি প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শিশু মারা যেত। বর্তমানে সেটি প্রতি হাজারে ৮ দশমিক ১। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত-জন্ম শিশুর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৩ এ নামিয়ে আনতে হবে। তবে এখনো দেশে যেসব শিশু নিউমোনিয়াতে মারা যাচ্ছে তার ৫২ শতাংশই বাড়িতে কোনো ধরনের চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাচ্ছে। ৩ শতাংশ মারা যাচ্ছে বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে। আর হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার পরও নিউমোনিয়াতে মারা যাচ্ছে ৪৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বে অন্যান্য রোগে মৃত্যুর চেয়ে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ৭৫ শতাংশের বেশি নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকরা আরও বলছেন, সারা বিশ্বে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ার ফলে বিগত বছরের চেয়ে অতিরিক্ত ১৯ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামন কামরুল বলেন, টিকা, স্বাস্থ্যকর জীবন এবং পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা এই তিনটি বিষয় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারে। দেশে রোগটির চিকিৎসায় উপজেলা পর্যায়েও শিশু চিকিৎসক রয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে রোগটি সম্পর্কে অসেচতনতা রয়েছে। রোগী ও অভিভাবকের অজ্ঞতায় যথা সময়ে হাসপাতালে যান না। বিশেষ করে নগরায়ণের ফলে দূষণ এবং প্রান্তিক পর্যায়ে রোগীদের অসচেতনায় নিউমোনিয়া হচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি (বিপিএ) অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, করোনা মধ্যে থেকে যাওয়া নিউমোনিয়া টিকা কার্যক্রম কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে। এই টিকা কার্যক্রমে গতি আনতে হবে। শিশুর পুষ্টির উন্নতিকরণে কাজ করতে হবে।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১২ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস-২০২১। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘সচেতনতাই পারে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে।’ দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন সহ নিউমোনিয়া নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *