৫০ বছরের ২৫ সম্মেলনেও লাভ হয়নি পৃথিবীর

নিউজ ডেস্কঃ গত শতকের সত্তর দশকে শুরু। এরপর জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক ধরিত্রী সম্মেলনের পর বিশ্ব আরও অন্তত ২৫টি শীর্ষ জলবায়ু বৈঠক প্রত্যক্ষ করেছে। সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে পরিবেশবিজ্ঞানী, অধিকারকর্মী লাখ লাখ প্রতিনিধি অংশ নিয়েছে। হাজার হাজার ঘণ্টা ধরে আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ‘পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য’ করার সুন্দর সুন্দর প্রতিশ্রুতি এসেছে। ‘ঐতিহাসিক’ অনেক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।

বিশ্ব ৫০ বছর আগে যেখানে ছিল আজও সেখানেই আছে। ভয়াবহ গ্রিসহাউস গ্যাস নির্গমন এতটুকু রোধ করা যায়নি। বিশ্ব পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে প্রথমবারের মতো সম্মেলন হয় ১৯৭২ সালে। যা স্টকহোম সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই সম্মেলনেই জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন্স এনভারনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) গঠিত হয়। সেই সঙ্গে ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের আদি সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা, কার্বন নির্গমন রোধ ও কৃষিতে ডিডিটি পাউডার নামের একটি কীটনাশক নিষিদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করেন নেতারা। সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্মেলন।

স্টকহোম সম্মেলনের ২০তম বার্ষিকীতে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় আরও তিনটি ধরিত্রী সম্মেলন। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে এই সম্মেলনে ১৭২টি দেশের দুই হাজার ৪০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। কয়েক দিনের আলোচনা আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় আটশ পৃষ্ঠার এজেন্ডা-২১। ২৭টি নীতিমালা নিয়ে ঘোষণা করা হয় ‘রিও ডিক্লারেশন’। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’ শব্দগুচ্ছটি বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিনের সেই রিও সম্মেলনে জলবায়ু ও পরিবেশের ইস্যুগুলো প্রধান আলোচ্য ছিল, ২৯ বছর পর চলতি ২০২১ সালেও ঘুরেফিরে সেগুলোই আলোচনার টেবিলে স্থান পাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে স্বাক্ষরিত হয় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘ রূপরেখা ‘ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (ইউএনএফসিসিসি) যা ১৯৭টি সদস্য দেশের সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত হয় কাজের অগ্রগতি মূল্যায়নে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হবে ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’ বা কপ সম্মেলন। যার প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয় তিন বছর পর ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে। এরপর একে একে আরও ২৪টি কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবারই জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে নানা বিতর্ক, বড় বড় প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সম্মেলন।

কিন্তু পরিবেশ ও প্রকৃতির তেমন কোনো উন্নতিই হয়নি। বরং আরও অবনতি হয়েছে। পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাতোভিচে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৪। ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ওই সম্মেলনে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১-এর প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করা যায় সেটাই ছিল কপ-২৪-এর টানটান উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তার বিষয়। এরপর ২০১৯ সালে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত কপ-২৫ সম্মেলন থেকেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন আসেনি।

সম্প্রতি একের পর এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, শিল্প বিপ্লবের যুগের পর থেকে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতটুকু বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল, বৃদ্ধি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এতদিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করছিলেন, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সমুদ্রস্তরের উচ্চতা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পাবে এক মিটারের একটু কম। সর্বশেষ গবেষণাটি বলছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে পারে তার প্রায় দ্বিগুণ।

‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায়প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কার্বন নির্গমন যেভাবে চলছে তা কমানো না গেলে আগামী দিনের পৃথিবী এখনকার চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণতর হবে। সে ক্ষেত্রে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৬২ সেন্টিমিটার থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এখন সারা বিশ্বের চিন্তা, উদ্বেগ এবং পরিকল্পনা এ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারাকে দেড় ডিগ্রি থেকে দুই ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *