আমেরিকার শরৎকাল এবং তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশে যখন ছিলাম তখন দেখতাম বর্ষা যখন কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিচ্ছে, তখন শরৎ বাবু মুখে মিষ্টি  একটা সাদা হাসি আর বুকে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সাদা মেঘের ভেলায় আকাশের নীল যখন ঘুরে বেড়াতো, যখন কাশফুলের সাদা ঢেউয়ে প্রকৃতি দোল খেতো,  যখন শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের বিছানায় শিউলি ফুলের মেলা বসতো তখনই আমরা বুঝতাম এইতো শরৎকাল এলো। এইতো প্রকৃতি খুব আয়োজন করে তার যাবতীয় প্রসাধানি নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে বসবে আর নিজেকে আরও রুপময় করে তুলবে। এইতো সময় যখন আমাদের প্রতিটি ভোর সাদা আর জাফরন রংয়ে  রঙিন হয়ে উঠবে।
.
নিউইয়র্ক যখন আসলাম তখন প্রথম প্রথম এখানকার সবকিছুর সাথে দেশের সবকিছুর তুলনা করতাম। তুলনা করতে গিয়ে মাঝেমাঝে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম, মাঝেমাঝে মন খারাপ হতো। ঋতুর তুলনা যখন করতাম তখন সব সময়ই মনে হতো এখানকার শীত, বসন্ত বা  গ্রীষ্মের চেয়ে বাংলাদেশের শীত, বসন্ত বা গ্রীষ্ম অনেক ভালো। কিন্তু যখন এখনকার শরতের সাথে বাংলাদেশের শরতের তুলনা করতাম তখন শীত, বসন্ত বা গ্রীস্মের মতো করে কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারতাম না বা এখনও পারিনা। একবার মনে হয় বাংলাদেশের শরৎকাল এখনাকার থেকে বেশি সুন্দর, আরেকবার মনে হয় না  এখানকার শরৎকাল বাংলাদেশের থেকে বেশি সুন্দর। দিনশেষে বলা যায় দুইখানের শরৎকালই সুন্দর, দুই রকম সুন্দর। দুইখানেই প্রকৃতি শরৎকালে সাজে তার নিজের মতো করে।
.
শরৎকালের আভিধানিক ইংরেজি ‘অটাম’  কিন্তু এখানে লোকজন একে ‘ফল’ নামে ডাকে। শীত ও  গ্রীষ্মের মাঝমাঝি সময়টাই এখনাকার শরৎকাল। শরৎ শুরু হওয়ার সাথেসাথে আস্তেআস্তে করে দিন ছোট হয়ে আসতে শুরু করে, রাত বড় হতে থাকে। গাছের পাতা’রা রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করে। হলুদ, লাল, কমলা রঙের পাতাওয়ালা গাছদের দেখলে মনে হয় কোন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হয়ত তার রংতুলি দিয়ে খুব আয়োজন করে গাছেদের সাজিয়ে দিয়ে প্রদর্শনী করছেন। যে প্রদর্শনীর নির্দিস্ট কোন সীমা নেই। মাইলের পর মাইল সেই প্রদর্শনী চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয় সেই প্রদর্শনী দেখতে। যদিও পাতাদের এই রঙিন জীবন খুব একটা দীর্ঘ হয়না। শরৎ তার বিদায়ের আগে সব পাতাদের ঝরিয়ে দিয়ে যায়। চেনাজানা পথগুলা যেন হয়ে উঠে ঝারাপাতার বিছানা। যেটা দেখে গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করেঃ
‘ ও ঝরা পাতা ও ঝরা পাতাগো
তোমার সাথে আমার রাত পোহানো কথাগো
তোমার সাথে আমার দিন কাটানো কথা’
.
শরৎকাল হলো এখানকার উৎসবের ঋতু। শরৎ আসার সাথেসাথে উৎসবের আমেজে মেতে উঠে এখানকার চারদিক। চাষিরা মনের আনন্দে তাদের ফলানো ফসল (ভুট্টা) ঘরে তুলেন। বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন এবং আদি নৃত্যে সাজানো থাকে তাদের সেই ফসল তোলার উৎসব। অ্যাপল বাগানগুলা আপেল পিকিংয়ের জন্য সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আপেল পিকিংটা অনেকটা বনভোজনের মত। মানুষ দলেদলে গাড়িতে করে অ্যাপল পিকিংয়ে বিভিন্ন ফার্মে যায়। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে ব্যাগ ভর্তি করে আপেল নিয়ে আপেল নিয়ে ঘরে ফিরে। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে শুরু হয় এখানকার আরেকটা বড় উৎসব হ্যালোইনের আয়োজন। মিষ্টি কুমড়ার দিয়ে বানানো হয় বিভিন্নরকমের মুখোশ ও বাচ্চাদের জন্য ঝুড়ি। আজব ভুতুড়ে পোষাক পড়ে মানুষ রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, বাচ্চারা পামকিনের ঝুড়ি নিয়ে ক্যান্ডি কুড়াতে বের হয়। ভুতুড়ে পার্টি চলতে থাকে বার-রেস্তুরাগুলাতে। অক্টোবরের ৩১ তারিখে  ‘হ্যালোইন’ পালন করা হয়। নভেম্বরের  ৪র্থ বৃহস্পতিবারে পালন করা হয় এখানকার আরেকটা বড় উৎসব ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’। অনেকে মজা করে এটাকে ‘টার্কি ডে’ও বলে থাকে। কারণ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দোকানে বিক্রি করা হয় টার্কি, সবার ডাইনিং টেবিল সাজানো টার্কি দিয়ে, রেস্টুরেন্টগুলার খাবার তালিকা টার্কির আইটেমে ভরে উঠে। সবাই পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ সবাই একত্রিত হয়ে একসঙ্গে ডিনার, গল্পগুজব অ নানান অনুস্টানের মাধ্যমে এই দিন অতিবাহিত করে।
.
শরৎকাল, শরৎকালের উৎসব, শরৎকালের আনন্দ, শরৎকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এসব  নিয়ে লিখতে গেলে পৃস্টার পর পৃস্টা লেখা যাবে কিন্তু শেষ হবেনা। সেটা যে কোন দেশেরই শরৎ হউক না কেন।  রবি ঠাকুর শরৎ নিয়ে তার কবিতায় বলেছেনঃ
“আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি
মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা।”
কবি শামসুর রাহমান শরৎ নিয়ে তার কবিতায় বলেছেনঃ
“জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমিষে শরতের খুশির জ্যোতিকনা”
…….
মাসুম আহমদ
নিউইয়র্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *