যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না

রিজিয়া রহমানের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। দেশে তখন উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনাবশত ঘটছিল নানা ঘটনা। সেই সূত্রে এল তাঁর উপন্যাস আলবুর্জের বাজ–এর কথা, যেখানে অনেক আগেই তিনি লিখেছেন ধর্মীয় উন্মাদনার বিষয়ে, ওই উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনেই শুরু হলো আলাপন। পরে ধীরে ধীরে ধর্ম ও সংস্কৃতি ছুঁয়ে সে কথা ছড়িয়ে গেল তাঁর লেখার জগতেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বদরুন নাহার।

বদরুন নাহার: আলবুর্জের বাজ যখন লেখেন, সেই সময়টার কথা মনে আছে?

 

রিজিয়া রহমান: লেখার প্রথম দিকে ঘরের কাজগুলো দেখতাম আর লিখতাম। শেষের দিকে বের হইনি ঘর থেকে। বুয়া আছে, রান্না করে। টেবিলে খাবার দিয়ে দিত, আমার ছেলে-বউ—ওরা নিজেরাই খেয়ে নিত। আমাকে ডেকে বিরক্ত করত না। হয়তো বিকেলে উঠলাম, ধুমধাম করে সন্ধ্যায় গোসল করে আবার লিখতে বসতাম। যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না। এই উপন্যাসে তো আছে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারস্যাপার। ওইখানে সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিল ইরাকের বাগদাদ শহরের বর্ণনা লিখতে। খুবই কষ্ট হয়েছিল। এ বই, সে বই, হেন-তেন কিছুতেই খুঁজে পাই না। খুব টেনশনে আছি। মনে মনে ভাবি বাগদাদ এ রকম হবে, ও রকম হবে। এরপর একদিন স্বপ্নে দেখি বাগদাদের রাস্তায় হাঁটছি! মানে বাগদাদ এত বেশি মাথায় ঢুকেছে যে আমি বাগদাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তো পরের দিন উঠে কবি রুবী রহমানকে বললাম, ‘রুবী, আমি খুব বিপদে ছিলাম। বাগদাদ শহরকে কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিলাম না। কালকে স্বপ্নে আমি বাগদাদ দেখেছি।’ আচ্ছা, বইটা পড়েছ কি? আলবুর্জের বাজ?

 

বদরুন: জি, পড়েছি।

 

রিজিয়া: আলবুর্জ পর্বতমালা যেটা, নর্দান মাজেন্দার। ওই জিনিসটা দেখার ইচ্ছা আমার। যেটাতে ওদের ঘাঁটি ছিল। কেমন এলাকাটা? ওখানে ঘরবাড়ি, গ্রাম আছে কি না? ইরানি টেলিভিশনে খুব ভালো ভালো সিনেমা দেখাত। আমি তা দেখতাম। হঠাৎ একদিন দেখি যে নর্দান ইরান। ইরানের যে পাহাড়ি এলাকা আছে, ওটা দেখাচ্ছে। আমি এটার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। আমার মাথার ভেতর কেবল ছিল ওই আলবুর্জ পবর্তমালা। বাগদাদ আর দামেস্ক। দামেস্ক আমি পেয়েছি ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোর বইয়ে। কিন্তু আলবুর্জ পর্বত পাচ্ছিলাম না। তো টিভিতে দেখলাম একদম রঙিন ছবি! উঁচু পর্বত যার ঢাল বেয়ে, নিচুতে গ্রিন ভ্যালি। দুম্বা চরছে, ছাগল চরছে, বাড়ি আছে।

 

বদরুন: আলবুর্জের বাজ–এ ভিন্ন মতবাদের কারণে যে দল গঠন, বিষয়টি কি শুধুই আপনার কল্পনা নাকি ইতিহাস থেকে নিয়েছিলেন?

 

রিজিয়া: অবশ্যই ইতিহাসের। ভিত্তিটা তো ইতিহাসের। আমার আবার বই পড়ার খুব নেশা। ইচ্ছা ছিল মার্কো পোলোর বাংলা বইটা না পড়ার, ইংরেজি বইটাই পড়তে চাই। ওটা আমার ছেলে কিনে এনেছিল। ওই বইটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় দেখলাম মার্কো পোলো লিখেছেন, আলবুর্জ পর্বতমালায় একটা ঘাঁটি ছিল। আশপাশের গ্রাম থেকে ওই কম বয়সী—১২ থেকে ২০–এর মধ্যে যাদের বয়স—স্বাস্থ্যবান ওই ছেলেপেলেকে ধরে আনা হতো। ওদেরকে প্রশিক্ষণ দিত, হাশিশের নেশা ধরাত। এভাবে ওদের তৈরি করত।

 

বদরুন: সারা বিশ্বে এখন মুসলমানদের অনেকেই উগ্র পন্থার দিকে চলে যাচ্ছে…

 

রিজিয়া: ওটা ওসামা বিন লাদেনই শুরু করেছিল। এই উগ্রপন্থার আবির্ভাবও তো আরবে। ওসামা বিন লাদেনই এটা সামনে এনেছিল। পরে তা ছড়িয়েছে। আর এখন তো এটা একটা অদ্ভুত ফ্যান্টাসির মধ্যে চলে গেছে।

 

বদরুন: ধর্মীয় উগ্রবাদের যে সমস্যা, তা তো মুসলমানদের দিয়েই করানো হচ্ছে।

 

রিজিয়া: সারা পৃথিবীতে এখন যে জাতীয়তাবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসব সেই হিটলারের সময় থেকে চলে আসছে। তারপর আন্তর্জাতিকতাবাদ এটা হলো মানুষের স্লোগান। সেটাও তো বহু বছর হয়ে গেল। এখন আবার সবাই পেছনের দিকে ফিরছে। হ্যাঁ, পৃথিবীটা আবার জাতীয়তাবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। আসলে আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি। সেই হিসেবে আমরা নিজেদের বাঙালিরূপে ব্যাখ্যা করি। আসলে ভাষাই আমাদেরকে তৈরি করেছে। যেহেতু আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা, বিভিন্ন বর্ণের লোক মিলেই তো বাংলাদেশ।

 

বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলায় এই বিষয়গুলো আছে। ইসলাম এখানে যে এল, রয়েছে সে প্রসঙ্গও।

 

রিজিয়া: আমার কথা হলো, নানা দেশে নানান জাতি এসেছে, নানান ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। এখন এগুলো এত বছরে, হাজার বছরে মিশ্র সংস্কৃতি হয়ে গেছে।

 

বদরুন: আমরা কি সুনির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতিতে পৌঁছাতে পেরেছি বলে মনে করেন?

 

রিজিয়া: অবশ্যই পৌঁছেছি। ষাট দশক থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত। তবে এই সময়ে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কৃতির যে ধরন–ধারণ, তা কিন্তু এবং আমদানীকৃত একটা সংস্কৃতি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *