নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে কী হচ্ছে ?

নিউজ ডেস্কঃ নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে দুই শতাধিক প্রবাসীর ফিসহ পাসপোর্ট, নো-ভিসা রিকোয়ার্ড এবং অন্যান্য সেবা চেয়ে করা আবেদনপত্র গায়েব হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে সশরীরে আবেদন গ্রহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রবাসীরা ডাকযোগে আবেদন পাঠানো শুরু করেন। আবেদনের সঙ্গে মানি অর্ডারের অর্থও জমা দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু এসব আবেদনপত্র কনস্যুলেটে পৌঁছালেও অফিশিয়ালি জমা হয়নি। প্রেরক কোনো রসিদও পাননি। ফলে ভুক্তভোগীরা না পেয়েছেন পাসপোর্ট, না পেয়েছেন নো-ভিসা। উল্টো খোয়া গেছে তাদের পুরোনো পাসপোর্ট ও জরুরি কাগজপত্র। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
। আবেদনপত্র গায়েব হওয়ার ঘটনা প্রথম ধরা পড়ে গত বছরের জুন মাসে। সেটা বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গোচরীভূতও হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কনস্যুলেটের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেটা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।
এদিকে করোনাকালে কনস্যুলেট থেকে প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা না পেয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বহু প্রবাসী। তাদের বক্তব্য, বৈশ্বিক মহামারির কারণে কনস্যুলার সেবা বিশ্বজুড়েই ব্যাহত হয়েছে, এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু কোনো দেশই তার নিজ দেশের নাগরিকদের সেবা দিতে অজুহাত দেখায়নি। ব্যতিক্রম ছিল কেবল নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনুস্যলেট। বরং অনেক প্রবাসী সেবা নিতে এসে কনস্যুলেটের কোনো কোনো কর্মকর্তার দুর্ব্যবহারে কান্না করে ফিরে গেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।
শুধু করোনাকালে নয়, নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের অভিযোগ সব সময়ই ছিল। প্রবাসীদের কোনো অভিযোগই আমলে নেয় না তারা। বিভিন্ন সময়ে সরকারের মন্ত্রীরা নিউইয়র্কে সফরে এলে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। মন্ত্রীরা আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
এদিকে কনস্যুলেটের যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ এসেছে, তাকে পাসপোর্ট ও ভিসা সেকশন থেকে সরিয়ে অন্য সেকশনে দেওয়া হয়েছে। কনস্যুলেটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আবেদনপত্র ও মানি অর্ডারের অর্থের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। সম্প্রতি ওই কর্মকর্তা অসুস্থতাজনিত ছুটি নিয়েছিলেন। সোমবার তিনি কর্মস্থলে ফিরেছেন।
একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের মার্চে করোনায় নিউইয়র্ক সিটি লকডাউন হওয়ার পর বাংলাদেশ কনস্যুলেটে সরাসরি আবেদন গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। পাসপোর্ট, ভিসা ও অন্যান্য সেবার জন্য আবেদনকারীদের সুনির্দিষ্ট ফিসহ ইউএস পোস্টাল সার্ভিসের ফিরতি খামসহ আবেদনের পরামর্শ দেওয়া হয়। নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের আওতাধীন রাজ্য কানেকটিকাট, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নিউজার্সি, নিউইয়র্ক, মেইন, ম্যাসাচুসেটস, রোড আইল্যান্ড ও ভারমন্ট থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মেইল ইন সার্ভিসের নির্দেশনা মেনে আবেদন গ্রহণ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব আবেদনপত্র থেকে বহু আবেদন কনস্যুলেটে পৌঁছালেও রিসিপ্ট লেটার বা জমাদানের কোনো রসিদ পাননি আবেদনকারীরা। ভুক্তভোগীরা দিনের পর দিন কনুস্যলেটে ফোন করেও এ ব্যাপারে কোনো উত্তর পাননি। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ম্যাসাচুসেটস ও কানেকটিকাটের একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিন্ন অভিযোগ করেছেন। কনস্যুলেট অফিসে ফোন করলে কেউ রিসিভ করেন না। মাঝেমধ্যে ফোন ধরলেও পরে ফোন করতে বলা হয়। অনেক সময় তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের আবেদনের ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি। অথচ তাদের আবেদনপত্র যে রিসিভ হয়েছে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগের প্রমাণপত্র রয়েছে।
নিউইয়র্কের এলমহার্স্টের বাসিন্দা সিলেট প্রবাসী এক নারী অভিযোগ করেন, তিনি নিজ পরিবারের পাঁচ সদস্যের জন্য একসঙ্গে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন। প্রায় চার মাস পর পরিবারের তিনজনের পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। কিন্তু অন্য দুজনের আবেদনেরই কোনো হদিস নেই। ফলে জরুরি প্রয়োজনেও পরিবারের সবাই মিলে বাংলাদেশে যেতে পারেননি। এ ব্যাপারে কনস্যুলেটের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি ওই নারী।
সূত্র জানায়, একের পর এক অভিযোগ আসার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এ ধরনের অভিযোগ একত্র করার পর প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে দুই শতাধিক আবেদনপত্রের কোনো হদিস নেই। প্রতিটি আবেদনপত্রের সঙ্গে মানি অর্ডার ছিল, সেগুলোও নেই। জরুরি পাসপোর্টের জন্য ২২০ ডলার, সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ১১০ ডলার এবং নো-ভিসার জন্য ৫০ ডলারের মানি অর্ডার দিয়েছিলেন আবেদনকারীরা। সব মিলিয়ে প্রথমে প্রায় ৪৫ হাজার ডলারের গরমিল ধরা পড়ে। পরে এই অঙ্ক আরো বড় হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭০ হাজার ডলারে। কনস্যুলেটে যিনি ডেসপাচের দায়িত্বে আছেন, তিনি এসবের কোনো হিসাব দিতে পারেননি।
এদিকে এ ঘটনা যাতে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে না পৌঁছায়, সে জন্য ব্যাপক তৎপরতা চলছে। গত প্রায় ৭ মাস ধরে নানাভাবে এই অনিয়মের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে কনস্যুলেটের সেই অপতৎপরতা ভেস্তে গেছে, ইতিমধ্যে ঢাকায়ও এ খবর পৌঁছে গেছে। ঢাকা থেকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, এ ঘটনার একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে। কনস্যুলেটের নানা অনিয়ম এবং সেবার ব্যাপারে প্রবাসীদের একের পর এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কনস্যুলেটের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর সরকারের ওপর মহল চরম নাখোশ। ওই কর্মকর্তাকে যেকোনো সময় প্রত্যাহার করা হতে পারে।
নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের সেবার মান নিয়ে প্রবাসীরা বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত গুগল রিভিউতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা কনস্যুলেটের সেবা নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। তারা কনস্যুলেটের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বিভিন্ন ছবি পোস্ট করেছেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। ৪৪৯ জনের মধ্যে রেটিং পেয়েছে ২ দশমিক ৮। কিন্তু কনস্যুলেটের কর্মকর্তারা এই রেটিংকে পাত্তাই দিতে চান না।
শেখ হোসেন নামের এক ব্যক্তি কনস্যুলেটের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লিখেছেন, ‘এই লোক এখানে কাজ করার যোগ্য নন। তার কাছে কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিতে চান না। কোনো ধরনের সহায়তাও করেন না।’
নাফিসা সৈয়দা লিখেছেন, এখানে যারা কাজ করছেন তারা অভদ্র এবং অপেশাদার। ইংরেজিও জানেন না। যারা সেবাগ্রহীতা তাদের সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলেন। তারা নাকি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আজহারুল ইসলাম নামের আরেকজন লিখেছেন, কনস্যুলেটের কর্মকর্তারা জানেন না কীভাবে গ্রাহকসেবা দিতে হয়। তাদের নতুন করে শেখানো উচিত।
এদিকে মানি অর্ডারসহ আবেদন গায়েব, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং সেবার মান নিয়ে অভিযোগের ব্যাপারে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসার কাছে জানতে চাইলে তিনি ঠিকানাকে বলেন, নিউইয়র্ক কনস্যুলেটে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন ঘটনা তিনি শোনেননি। পরে তিনি তার ফোনেই কনস্যুলেটের ফার্স্ট সেক্রেটারি (পাসপোর্ট ও ভিসা) শামীম হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অভিযুক্ত কর্মকর্তার ব্যাপারে জানতে চাইলে কনসাল জেনারেল বলেন, ওই কর্মকর্তা অসুস্থ। তাকে অন্য সেকশনেও বদলি করা হয়নি। খুব শিগগির তিনি কর্মস্থলে যোগ দেবেন।
পরে ফার্স্ট সেক্রেটারি শামীম হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি মানি অর্ডারসহ আবেদনপত্র গায়েবের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকানাকে তিনি জানান, অনেকে অসম্পূর্ণ আবেদনপত্র পাঠান, সেগুলোর ব্যাপারে কনস্যুলেট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের আবেদন ফেরতও পাঠানো যায় না।
শামীম হোসেন আরো জানান, নিউইয়র্ক কনস্যুলেট করোনার মধ্যে সাধ্যমতো সেবা দিচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেবা দিয়েছেন। কোনো প্রবাসী যাতে পাসপোর্টের জন্য ভোগান্তির শিকার না হন, সে ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা চেষ্টাও করছি। কিন্তু কিছু আবেদন পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে দীর্ঘদিন আটকে আছে। এ ব্যাপারে কনস্যুলেটের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকে আবেদনে যে ঠিকানা ব্যবহার করেন, সেখানে থাকেন না। পুলিশ তদন্তে গিয়ে সেখানে তাদের পায় না। আাবার অনেকে আগের পাসপোর্টে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে গরমিল রেখে আবেদন করেন। এসব কারণেও পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হচ্ছে।
পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণের পর জমার রসিদ দেওয়া হয়নি এ অভিযোগ প্রসঙ্গে শামীম হোসেন বলেন, রসিদ পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আবেদনকারীরা পাসপোর্ট বা ভিসার জন্য ফিরতি খামসহ আবেদন করেন। রসিদ পাঠাতে হলে কনস্যুলেটের অর্থ খরচ করতে হবে, যার অনুমোদন নেই।
কনস্যুলেটের সেবা নিয়ে গুগল রিভিউর ব্যাপারে শামীম হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সেবা নিয়ে যারা অসন্তুষ্ট হন, তারাই গুগলে গিয়ে নেতিবাচক রিভিউ লেখেন। কিন্তু যারা সেবা পেয়ে খুশিমনে ফিরে যান, তারা আর রিভিউ লেখেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *