শত্রুর সাথে রাসুল (সা.) এর আচরণ

বর্তমানে ইসলামকে সংঘাত ও সহিংসতার ধর্ম বলে প্রচার করা হয়। অভিযোগ করা হয়, ইসলাম তার অনুসারীদের সংঘাত ও সহিংস হতে উৎসাহী করেছে।
অথচ শত্রুর সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও ইসলামের নবী (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁর বিশ্বাসের কারণে তিনি প্রচন্ড প্রতিকূলতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর শত্রুরা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলো এবং তাঁকে খুন করার চেষ্টাও করেছিলো। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাদের শত্রুতার জবাব দিয়েছিলেন দয়া ও সৌন্দর্যের মাধ্যমে।
সবসময় তিনি তার শত্রুদের জন্য প্রার্থনা করতেন। তিনি কামনা করতেন, তারাও যেনো আল্লাহর দীক্ষা লাভ করতে পারে। তারা ক্ষতিগ্রস্থ বা অভিযুক্ত হোক এটি তিনি কখনও চাইতেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিলো ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতেই ইসলামের মাধ্যমে সকল মানুষের কল্যাণ সাধন করা।
একবার রাসূল (সা.) এর সাহাবাগণ তাঁর শত্রুদের দ্বারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাঁরা রাসূল (সা.) এর কাছে আবেদন জানান, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’
কিন্তু রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন, ‘আমি অভিশাপ দেওয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৫৯৯)
অন্য এক সময় সাহাবারা রাসূল(সা.) এর বিরোধিতাকারী দাউস নামের এক গোত্রের ধ্বংস কামনা করে বলছিলেন,
‘আল্লাহ যেনো দাউস গোত্রকে ধ্বংস করে ছাড়েন।’ কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) দুআ করলেন, ‘হে আল্লাহ! দাউস গোত্রকে হেদায়েতের পথ দেখাও এবং আমার নিকটে নিয়ে আসো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৪১৩১)
হুনাইনের যুদ্ধে সাহাবারা রাসূল (সা.) এর কাছে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সাকীফ গোত্রের তীর আমাদের ছিন্নভিন্ন করেছে। তাদের ধ্বংসের জন্য দুআ করুন।’
কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) দুআ করলেন, ‘হে আল্লাহ! সাকীফ গোত্রকে হেদায়েত দান করুন।’ (তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৯৪২)
উহুদ যুদ্ধের সময় শত্রুদের দ্বারা রাসূল (সা.) নিজেও আহত হয়েছিলেন এবং তার চেহারা হতে রক্ত ঝড়ছিলো। এই অবস্থাতেও রাসূল (সা.) তাদের জন্য দুআ করলেন,
‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা করুন। তারা জানে না যে, তারা কী করছে।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং: ৯৮৫)
এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নবীজি (সা.) তাঁর শত্রুদের জন্য আল্লাহর কাছে শুধু ক্ষমা প্রার্থনাই করতেন না, বরং তিনি তাদের জন্য কৈফিয়তও প্রকাশ করতেন।

ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য এটি নয় যে, মানুষকে জোর করে মুসলমান বানাতে হবে। ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
রাসূল (সা.) সকল যুদ্ধে একটি সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে চলতেন। যুদ্ধের সময় কোনো নারী, শিশু, ধর্মীয় পাদ্রী/পুরোহিত, শ্রমিক, যুদ্ধ হতে বিরত সাধারণ মানুষ এবং আত্মসমর্পণকারী সৈনিকদের হত্যা না করতে তাঁর কঠোর নির্দেশনা ছিল।
একইসাথে তিনি অন্য ধর্মের লোকদের গির্জা, মন্দির বা সম্পত্তি ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন। যুদ্ধের মধ্যে দুর্ঘটনায়ও যাতে কোনো প্রাণীসম্পদের ধ্বংস না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধ বা শান্তিকালীন কোনো সময়ই কাউকে জোর করে মুসলমান বানাতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন।
যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর আচরণ ছিলো কুরআন হতে উৎসারিত। কুরআনের সূরা ইনসানের আট নং আয়াতে সেই মুসলমানদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা নিজেদের পূর্বে যুদ্ধবন্দীদের খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করেছে। রাসূল (সা.) যুদ্ধবন্দীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য কঠোরভাবে আদেশ প্রদান করেছেন।
বদর যুদ্ধের একজন বন্দী আবু আজিজ ইবনে উমায়ের থেকে জানা যায়, তিনি যখন বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে এসেছিলেন, তখন মদীনার নাগরিকরা নিজেরা না খেয়ে তাদের জন্য রুটির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই আচরণই তাকে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম গ্রহণে। (মু’যাম আল কবীর)
অপর একটি বর্ণনা হতে জানা যায়, রাসূল(সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলিম তার বন্দীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং: ৩২)
ক্ষতির কোনো আশংকা না থাকলে রাসূল (সা.) সাধারণভাবে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দিতে উৎসাহ প্রদান করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৫০৫৮)
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ইতিহাস হচ্ছে দয়া, ক্ষমা এবং মুক্তির। রাসূল (সা.) দীর্ঘ তেরো বছর মক্কায় শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার করেছিলেন। তিনি তখনই মদীনায় হিজরত করেন যখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে গিয়েছিলো। এরপর ক্রমাগত দশ বছর মদীনায় মুসলমানরা মক্কার আক্রমণ প্রতিহত করে একতা ও বিশ্বাসের বলে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।
মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা.) তাঁর সেই শত্রুদের উপর ক্ষমতার অধিকারী হন, যারা দীর্ঘ তেইশ বছর বিভিন্নভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে, এমনকি তাঁর বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। রাসূল (সা.) ইচ্ছা করলে এইসময় তাঁর সকল প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সকলের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। (তারিখে দিমাশক)
মক্কা বিজয়ের দিন কোনো প্রকার প্রতিশোধ না নিয়েই রাসূল (সা.) তার শত্রুদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এটিই শত্রুর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *