মৃত্যুঞ্জয়ি সৈয়দ ইলিয়াস খসরু বাকি জীবনটা মানুষের সেবায় নিয়োজিত করতে চান

নিউইয়র্ক : নিউইয়র্কের গণমাধ্যম কর্মী সৈয়দ ইলিয়াস খসরু (৫১) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছেন। নগরীর বিখ্যাত কর্নেল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এক মাস ১৪ দিন হাসপাতালে থাকার পর ২২ এপ্রিল ওজনপার্কের বাসায় ফিরেছেন ইলিয়াস খসরু। এক মাসেরও বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছে তাঁকে। এত দিন ভেন্টিলেশনে থাকা এমন মাত্র দুজন রোগী করোনা জয় করে ফিরে আসতে পেরেছেন এই হাসপাতাল থেকে। চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইলিয়াস খসরুর শরীরের সব ফাংশন বিকল হয়ে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ও পালস বন্ধ হয়ে পড়েছে। পরিবারের কাছে ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চেয়ে হাসপাতাল থেকে ফোন করাও হয়েছিল। পরিবার রাজি হয়নি। পরদিন হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, ইলিয়াস খসরু বেঁচে আছেন, তাঁকে নজরে রাখা হচ্ছে। তবে নতুন করে চিকিৎসার কিছু নেই। জীবন যিনি দিয়েছেন, তাঁর কাছে যেন প্রার্থনা করা হয়।

 

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা গ্রামের ইলিয়াস খসরু ৯৮ সালে আমেরিকায় আসেন। দিনরাত পরিশ্রম করে আমেরিকার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজে জনপ্রিয় নাম ইলিয়াস খসরু। যুক্তরাষ্ট্র মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইলিয়াস খসরু নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত আইপিটিভি টাইম টেলিভিশনের অন্যতম পরিচালক।

 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে পরিবার নিয়ে ওমরাহ হজে গিয়েছিলেন ইলিয়াস খসরু। ফিরে আসেন ২৮ ফেব্রুয়ারি। এসেই কমিউনিটির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখনো নিউইয়র্কে করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো খবর ছিল না। এর চার-পাঁচ দিন পরই অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। শরীরে ব্যথা, জ্বর ও কাশিতে কাবু হয়ে পড়লে নগরীর কর্নেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন গত ৯ মার্চ। এর পরের ঘটনা আর তাঁর মনে নেই। আগে থেকেই ডায়বেটিক রোগী ইলিয়াস খসরু হাসপাতালে যাওয়ার পরই অচেতন হয়ে পড়েন। বাসায় ৭৫ বয়সী মা, স্ত্রী সাদিয়া, দুই ছেলে নাদের ও নাহিদ আর এক শিশু কন্যা নাবিদা। ইলিয়াস খসরু হাসপাতালে যাওয়ার পর তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয় অন্য একটি হাসপাতালে।

 

ইলিয়াস খসরু জানান, হাসপাতালে যাওয়ার ১০ দিন পরে তাঁর একবার চেতনা ফিরে আসে। এ সময় তাঁর মনে হতে থাকে, হাত-পা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে। একজন চিকিৎসক ইলিয়াস খসরুকে তাঁর করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি জানান। এ সম্পর্কে ইলিয়াস খসরুর তেমন কোনো ধারণা ছিল না। হাসপাতালে যাওয়ার আগে শুধু শুনেছিলেন, চীনে এমন একটা রোগে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

 

এ খবর শুনে ইলিয়াস খসরু তাঁর পরিবারের লোকজনের কথা জানতে চান। এ রোগে কেউ তাঁর কাছে আসতে পারবে না বলে জানানো হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সরাই তাঁর সর্বোচ্চ সেবা করছেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার দুবার অচেতন হয়ে যান ইলিয়াস খসরু। এভাবে মাস চলে যায়। ছেলে সৈয়দ নাদের হাসপাতালে যোগাযোগ রাখেন। তাঁকে শুধু জানানো হয়, ইলিয়াস খসরুর অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। একপর্যায়ে জানানো হয়, ইলিয়াস খসরুর কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করছে না। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশনে থাকা মানুষের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ, এ কথাও জানানো হয়। এতে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটি ও মিডিয়া পরিবারে ইলিয়াস খসরুকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। তাঁর জন্য দেশে গ্রামের বাড়িতে লোকজন প্রার্থনা করতে থাকেন। এর মধ্যেই এক রাতে জানানো হয়, ইলিয়াস খসরুর শরীরের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চার চিকিৎসকেরা। ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর খবর। কেবল আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর খবরটাই বাকি। বিষাদ আর বিলাপে ভারী হয়ে ওঠে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজ।

 

তবে ভেন্টিলেশন না খোলার অনুরোধ জানিয়ে বুকে পাথর বাঁধে খসরুর পরিবার। হাসপাতাল থেকেও এ নিয়ে আর কোনো জোর করা হয়নি। চিকিৎসকদের বিস্মিত করে কয়েক ঘণ্টা পরই ইলিয়াস খসরু একটু নড়ে চড়ে ওঠেন। এরপরের দিনগুলোতে তাঁর শরীরের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়। পরে আবার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকেরা আর কোনো আশার কথা শোনাতে পারেন না। মধ্য এপ্রিলের দিকে একবার চেতনা ফেরে তাঁর। চিকিৎসকেরা আবার উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বারবার এসে দেখতে থাকেন এ মৃত্যুঞ্জয়ী করোনা রোগীকে।

 

একমাস পর ইলিয়াস খসরুর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় কাউকে চিনতে পারেননি খসরু। জানালেন, সব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক কিং ও মাইকসন মাথায় হাত দিয়ে ইলিয়াস খসরুকে জানান, তুমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছ। এক মাসের বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থেকে এর আগে এই হাসপাতাল থেকে আর একজন রোগী এভাবে ফিরে এসেছিলেন। খসরু কৃতজ্ঞতা জানালেন চিকিৎসকদের। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, আমরা তোমার জন্য কিছুই আলাদা করে করিনি। এ জীবন যিনি সৃষ্টি করেছেন বলে তুমি বিশ্বাস করো, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাও। ইলিয়াস খসরু হাসপাতালেও বাংলাদেশি সৌজন্যতা ভুলে যাননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *