চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা আইয়ুব বাচ্চু

 

আইয়ুব বাচ্চু বাংলা ব্যান্ড সংগীতে এক কিংবদন্তির নাম। গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গিটারবাদক, গায়ক—সব মিলিয়ে আইয়ুব বাচ্চু। তিনি মঞ্চে উঠলেই অন্যরকম এক উন্মাদনা বিরাজ করত ভক্তমহলে। এই কিংবদন্তি শিল্পী শুধু ব্যান্ড জগতই দাপিয়ে বেড়াননি, ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও তুলেছিলেন আলোড়ন। বাংলা চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারার গানের মধ্যে তিনি এনে দিয়েছিলেন তারুণ্যের ছোঁয়া। সিনেমার গান তার গিটারের বিদ্যুতায়নে দেখেছিল এক নতুন দিগন্ত। ব্যান্ড গানের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রকে।

 

মান্না প্রযোজিত প্রথম সিনেমা ‘লুটতরাজ’-এর মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন আইয়ুব বাচ্চু। কাজী হায়াৎ পরিচালিত এই সিনেমায় তার গাওয়া ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ গানটি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। চলচ্চিত্রে গান করবেন এমন ভাবনা তার ছিল না। চলচ্চিত্রে আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে এসেছিলেন নায়ক মান্না। তাও অনেকটা জোর করেই। মান্নার একান্ত আগ্রহ আর তার অনেক অনুরোধের পর প্লেব্যাক করতে রাজি হয়েছিলেন তিনি।

 

প্লেব্যাকে আইয়ুব বাচ্চুর যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘‘আমি যখন ‘লুটতরাজ’ সিনেমাটি বানাচ্ছি তখন একটা চমক খুঁজছিলাম। হঠাৎ মান্না বলল—কাজী ভাই, আইয়ুব বাচ্চুর একটি গান সিনেমায় থাকলে কেমন হয়। আমি বললাম খুবই ভালো হয়। তরুণদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু সে কী সিনেমায় গাইবে? ব্যান্ডের তারকারা সচরাচর সিনেমায় গাইতে চান না। মান্না বলল, আগে কথা বলে দেখেন কী বলেন। পরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে আমি আলাপ করলাম। তিনি শুনেই না করে দিলেন। বললেন, বাচ্চু সিনেমায় গাইবে না কিছুতেই। আমি মান্নাকে জানিয়ে দিলাম যে হবে না। শুনে মান্না বলল, কাজী ভাই হবে। টেনশন কইরেন না আমি দেখতেছি ব্যাপারটা। কেমন করে কী করল জানি না। দুদিন পর মান্না এসে বলে, বাচ্চু ভাই রাজি। উনি ‘লুটতরাজ’ সিনেমায় গাইবেন। আমি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে জানালাম বিষয়টা। শুনে বুলবুল পাত্তা দিলো না। হেসে বলল, আমি বিশ্বাস করি না বাচ্চু গাইবে। মান্না তখন নিজে টেলিফোন করে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে কথা বলিয়ে দিলো। বাচ্চু নিজে জানাল যে, ‘বুলবুল ভাই গান লেখেন আমার জন্য। গাইব আমি।’ পরে মান্না জানিয়েছিল, তার অনেক অনুরোধে রাজি হয়েছিল বাচ্চু। এরপর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর ও সংগীতে তৈরি হয় গানটি। আইয়ুব বাচ্চুর গানের ধরণ মাথায় রেখেই গানটি লিখেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার সঙ্গে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কনকচাঁপা। অবশেষে গানে কণ্ঠ দিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই গান রাতারাতি পৌঁছে গেল সারাদেশের মানুষের কাছে। হাটে-ঘাঠে, মাঠে-ময়দানে বেজেছে ‘অনন্ত প্রেম’।’’

 

এদিকে এই নির্মাতার আরো একটি গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাজী হায়াৎ বলেন, ‘‘কিন্তু কে জানতো তার সঙ্গে আমার আরো একটি ঐতিহাসিক গানের অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে। ‘লুটতরাজ’ সিনেমায় জনপ্রিয়তার পর বাচ্চুর সিনেমার গানের প্রতি ভালো লাগা জন্মায়। পরবর্তীতে আমার আর মান্নার সঙ্গে ওর একটা জুটি গড়ে উঠেছিল। তারপর ‘তেজি’, ‘কষ্ট’সহ আরো কিছু সিনেমায় গেয়েছিল। কিন্তু ‘আম্মাজান’ সিনেমায় গানটি গেয়ে নতুন রেকর্ডের জন্ম দিয়েছিল সে। তার এই গান বাংলাদেশের বাইরেও ঝড় তুলেছিল বাংলার ভাষার শ্রোতা ও সিনেমার দর্শকের মনে। এই সিনেমার ‘স্বামী আর স্ত্রী বানাইছে কোন মিস্তিরি’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।’’

 

আকাশ চুম্বি জনপ্রিয়তা পায় ‘আম্মাজান’ গানটি। কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ সিনেমাটি ১৯৯৯ সালের ২৫ জুন মুক্তি পায় । এতেই ব্যবহার করা হয় এই গান। মুক্তির পর তখন তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এটি। গানটির কথা মনে হলে মনের অজান্তেই মায়ের প্রতি সম্মানবোধটা আরো বেড়ে যায়। ‘আম্মাজান আম্মাজান, চোখের মনি আম্মাজান/ বুকের ধ্বনি আম্মাজান, প্রাণের খনি আম্মাজান/ আম্মাজান আম্মাজান আপনি বড়ই মেহেরবান, জন্ম দিয়াছেন আমায়, আপনার দুগ্ধ করছি পান/ সবার আগে আমি আমার আম্মাজান রে চিনি রে আম্মাজানরে চিনি’—এমন হৃদয়স্পর্শী কথার গানটির লিখেছেন বিখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সুর ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। আর এতে ঠোঁট মিলিয়েছেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মান্না।

 

গানটি লেখা ও ‍সুর কীভাবে হয়েছে তার পেছনের সেই গল্প ২০১৮ সালের ১৩ মে, এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনি বলেন, ‘‘আম্মাজান’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন বিশিষ্ট পরিচালক কাজী হায়াৎ। তিনি কখনো গান নিয়ে আমার সঙ্গে বসতেন না। এ বিষয়ে তিনি আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন। তার বিশ্বাস আমাকে স্বাধীনতা দিলে ভালো কিছুই হবে। স্বাধীনতা ঠিকই দিয়েছিলেন কিন্তু আমাকে বলেছিলেন, ‘মাকে নিয়ে আরো অনেক গান রচিত হয়েছে। আমি ভাবলাম, এমন একটি গান লিখব যার কথার মধ্যে অনেক গভীরতা থাকবে। মক্কার ধুলো, মদিনার ধুলো, এই মাটি দিয়ে গড়া মায়ের দেহ। এসব কথাগুলো খুব চিন্তা-ভাবনা করে আনতে হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে এবং সুরটা এমনভাবে করেছি যা একটি শিশুও গাইতে পারবে। এই গানের সুর এমনভাবে তৈরি করেছি যা কেউ ভাঙতে পারবে না। অন্যভাবে গাওয়ারও উপায় নেই। গানের কথা ভালো হলে, সুরটা সাধারণ হলে সাধারণ মানুষও তা গাইতে পারেন। বাচ্চুর কথা মাথায় রেখেই এই গানটি আমি তৈরি করেছিলাম। কারণ এই সিনেমায় মান্না একজন ‘অ্যাংরি হিরো’ ছিল। তখন আমার চোখে মুখে বাচ্চুর মুখটাই ভাসছিল। বাচ্চু তখন ফিল্মে গান করেনি। বাচ্চুকে অনেক কষ্ট করে গানটি করানো হয়েছিল। বাচ্চু অনেক মেধাবী মিউজিশিয়ান। ও ছোটবেলায় আমার কাছে আসত। যাই হোক, আমার কাছে কয়েকবার শোনার পর বাচ্চু খুব স্বাভাবিকভাবে গানটি গাইল। রেকর্ডিং করতে যখনই যেতাম তখনই অনেক মানুষ গানটি শোনার জন্য চলে আসত। তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম গানটি হিট হবে। শ্রুতি স্টুডিওতে গানটির রেকর্ডিং হয়েছিল।’

 

‘আম্মাজান’ গানটি নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েই গেয়েছেন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। অনুভূতি ব্যক্ত করে এ গান প্রসঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু রাইজিংবিডিকে বলেছিলেন, ‘‘আম্মাজান’ গানটি আমি যখনই গাই তখনই মনে হয় আমি আমার মাকে নিয়েই গাইছি। মাকেই এই কথাগুলা বলছি। আমি এটা গান মনে করে গাই না। মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে গাই। গানটির সঙ্গে আমাকে যুক্ত করেছেন শ্রদ্ধেয় বুলবুল ভাই। তার অসাধারণ কথার এই গান বাংলার দর্শকের মুখে মুখে, এটা একজন শিল্পীর কাছে অনেক ভালো লাগার। মাকে নিয়ে আমি এমন একটি গান করতে পেরে নিজের কাছে খুব ভালো লাগছে। অনেক হিট গান রয়েছে কিন্তু মাকে নিয়ে যে ক’টা গান রয়েছে তার মধ্যে ‘আম্মাজান’ গানটি অন্যতম। এটা দর্শকের উপহার। আর এটাই বড় ভালো লাগা।’’

 

‘সাগরিকা’ সিনেমায় ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে’, ‘ব্যাচেলর’ সিনেমায় ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি প্রেম আমার উপরে পড়েছে’, ‘লাল বাদশা’  সিনেমায় ‘আরো আগে কেন তুমি এলে না’, ‘তেজী’ সিনেমায় ‘এই জগত সংসারে তুমি এমনই একজন’, ‘আম্মাজান’ সিনেমায় ‘আম্মাজান’, ‘স্বামী আর স্ত্রী’, ‘তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়’, ‘মেয়েরা মাস্তান’ সিনেমায় ‘ঘড়ির কাঁটা থেমে থাক’, ‘চোরাবালি’ সিনেমায় ‘ভুলে গেছি জুতোটার ফিতেটাও বাঁধতে’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু।

 

দেখতে দেখতে এই গিটার জাদুকরের প্রস্থানের এক বছর কেটে গেল। আজ ১৮ অক্টোবর তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে নানা আয়োজন চলছে সংগীতাঙ্গনে। এই অমর শিল্পীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে সংগীতপিপাসুরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *