কবি দিলওয়ার ছিলেন গণমানুষের এবং মানবতার কবি

কবি দিলওয়ার পয়লা জানুয়ারি, ১৯৩৭ সালে সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমার  ভার্থখলাস্থ পৈতৃক নিবাস ‘খান মঞ্জিল’-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী হাসান খান এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ রহিমুন্নেসা। উনার পুরো নাম দিলওয়ার খান।যদিও উনি কখনোই তাঁর পারিবারিক ‘খান’ পদবি কোথাও ব্যবহার করেন নি।  ১৯৫২ সালে সিলেটের উত্তর সুরমার রাজা জিসি হাইস্কুল থেকে এসসসি পাস করে এম সি কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন দিলওয়ার। পরবর্তিতে বিএতে পড়ার সময়কালীন উনি শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাজীবনের শুরু করেন।

স্কুলজীবন থেকেই উনার লেখালেখি শুরু করেন। দিলওয়ারের প্রথম কবিতা  ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় স্থানীয় একটা পত্রিকায়। ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের এগারো বছর পর ১৯৬৪ সালে উনি প্রকাশিত করেন উনার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঐকতান’। এরপর এক এক করে প্রকাশিত হয় বাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (প্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড(১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ,২০০১)।

শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাজীবনের শুরু করলেও পরবর্তিতে সাংবাদিকতা শুরু করেন কবি দিলওয়ার। ১৯৬৭ সালে সহকারী সম্পাদক দৈনিক সংবাদে হিসাবে যোগ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠেও সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন৷ দীর্ঘদিন উদীচী ও খেলাঘর আসরের সিলেটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সংবাদে  দুবছর কাজ করার পর ফিরে আসেন সিলেটে ফিরে এসে গড়ে তোলেন ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’।  উনসত্তরে যেমন এই সংগঠন সিলেটে চেতনার রসদ যুগিয়েছি ঠিক তেমনি একাত্তরেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ভিতরে থেকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন।

পঞ্চাশ দশকে বাংলা সাহিত্যকে যে কয়জন কবি সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে কবি দিলওয়ার অন্যতম। কবি দিলওয়ার ১৯৮০ সালে কাব্য চর্চায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। উনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার ছিলেন। কিন্তু সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক কবি। তিনি ছিলেন একজন গণমানুষের কবি, যার কবিতা সাধারণ মানুষের আবেগকে ছুঁয়ে ছিলো। যার কবিতায় উঠে এসেছিলো সাধারণ মানুষের জীবনের কথা। তাইতো সাধারণ মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাব্য জগতের মধ্যমণি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে  ১০ অক্টোবর ২০১৩ সালে সিলেট নগরের ভার্থখলায় নিজ বাসভবনে তার মৃত্যুবরণ করেন।

আজ ১০ অক্টোবর কবি দিলওয়ারের মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা শ্রদ্ধাভরা স্মরণ করছি মানুষ এবং মানবতার কবি কবি দিলওয়ার কে।

.

দিলওয়ারের নির্বাচিত পাঁচটি কবিতা

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন
============
শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়,
আমরা কি আজো দিতে পারলাম
মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খন্ডে  খন্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে
মানুষের বিধাতাকে।

প্রতিদিন ভোরে ও-কার সূর্য মর্মরক্তে ভিজে
আমাদের ঘরে আলো দিয়ে যায়
বিগলিত হয়ে নিজে?
ও-কার বাতাস প্রতি নিশ্বাসে বিশ্বজনীন হয়?
শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন,
এ তো ভুলবার নয়।

শুধু মুখে নয় বুকেও ক্ষরিত সাম্প্রদায়িক বিষ,
অঘ্রাণে তাই ব্যথারক্তিম ঐশী ধানের শিষ!
কতকাল ধরে, বলতে পারি না,
আত্মহনন কাজে-
ব্যস্ত রয়েছি আমরা সবাই। প্রভাত মথিত সাঁঝে।

কেটে গেল কত পিতামহ আর
প্রপিতামহের কাল,
বোধির গোড়ায় সার হলো কত
বিভেদের জঞ্জাল।

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন,
চিরাচরিতের পথে
জীবন কখনো চলতে পারে না-
নদীর জীবন স্রোতে!

ঔরসজাত মানবতা চাই
কালের শুদ্ধসুধা
রক্তে আমার এই তো ধর্ম,
এই তো মাতৃক্ষুধা।
.
মর্মজ্বালা
============
প্রিয়তমা চেয়ে দ্যাখো, তোমার চোখের জলের
দর্পণে
আমার বিপন্ন পৌরুষ:
বিবেকের সূচীমুখ দংশনে দংশনে
ক্ষত-বিক্ষত।
আমার মনের শান্তি পলাতক
তোমার মনের শান্তির ঠোঁট ছু্ঁয়ে।
আমার বিষণ্ন বসন্তের প্রভাতে ডাকে কাক:
বিদ্ধ তার লুব্ধ চঞ্চুতে দুগ্ধশুভ্র তোমার হৃদয়;
কিংশুক, পলাশ আর গুলমোহরের ডালে ডালে
উদ্ধতফণা বিষধর সর্পের সমারোহ!
গৃহলক্ষ্মী সেই চিরতুমি, সংসারের রণাঙ্গনে
অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত;
কাটাকপালের রক্তে অভিসিক্ত বুকের আচ্ছাদন।
ক্ষমাহীন শতাব্দীর সংগ্রামের পরিখায়
শ্বেতবস্ত্রে আচ্ছাদিত চিরন্তন নারীর মহিমা।
প্রিয়তমা ক্ষমা করো, তোমাকে একাকি ছেড়ে দিয়ে
রুগ্ন জন্তুর মতো বোবা চোখে, আহা,
আমি শুধু দেখ্ছি তোমাকে
রণাঙ্গনে রুধিরাক্ত।
তবুও কী আশ্চর্য! তুমি
চাওনা আমার ঘরে শোকের লোবান।
.
কীনব্রীজে সূর্যোদয়
============
এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখীকে দুলিয়ে।

নীচে জল কল্ কল্ বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা,
সৃষ্টির পলিতে সে-ই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।

সহসা ফিরিয়ে চোখ চেয়ে দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখীর কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ ।

ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কীনব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।

সত্য
============
এক সত্য, দুই সত্য, তিন সত্য এই
মাতৃভাষার চেয়ে কোন
বড় সত্য নেই।

এক সত্য, দুই সত্য, তিন সত্য এই
দেশদ্রোহী বড়ো দৈত্য
তার বড়ো কেউ নেই।

এক সত্য, দুই সত্য, তিন সত্য এই
মাতৃদুগ্ধ ছাড়া কোন
বড়ো পথ্য নেই।
.
রক্তে আমার অনাদি অস্থি
============
পদ্মা তোমার যৌবন চাই
যমুনা তোমার প্রেম
সুরমা তোমার কাজল বুকের
পলিতে গলিত হেম।

পদ্মা যমুনা সুরমা মেঘনা
গঙ্গা কর্ণফুলী,
তোমাদের বুকে আমি নিরবধি
গণমানবের তুলি!

কত বিচিত্র জীবনের রং
চারদিকে করে খেলা,
মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে
কাটায় মারণ বেলা!

রেখেছি আমার প্রাণ স্বপ্নকে
বঙ্গোপসাগরেই,
ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ
উপমা যে তার নাই!

এই ক্রোধ জ্বলে আমার স্বজন
গণমানবের বুকে-
যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ
নরদানবের মুখে!

পদ্মা সুরমা মেঘনা…
অশেষ নদী ও ঢেউ
রক্তে আমার অনাদি অস্থি,
বিদেশে জানে না কেউ!

=================
মাসুম আহমদ
নিউইয়র্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *