নিয়মনীতি সবার জন্য সমান হলে বরিসকে বিদায় নিতেই হবে

নিউজ ডেস্কঃ যুক্তরাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে একটা বিষয় খুব আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে করোনা ভাইরাস ক্রমেই বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তবে এগুলো নিয়ে ততটা আতঙ্কিত নন ব্রিটেনবাসী। বরং তাদের মধ্যে এই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে যে, করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করে এমনকি লকডাউনও।

সাধারণ মানুষ সেটা লঙ্ঘন করলেই শাস্তির মুখে পড়তে হয়। যাদের মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে তারাও খেতে যেতে পারেন না। অথচ সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যেন নিয়ম একটু ভিন্ন! তারা নিয়ম বানিয়ে তারাই আবার লঙ্ঘন করছেন। এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক কাণ্ড করে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবার সেই লকডাউন ভাঙার একই দোষে দুষ্ট প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। নিয়ম ভাঙার সাজা ঠিক রাখতে গেলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। সেই চাপটিও যেন দিন দিন বাড়ছে।

ব্রিটেনের আইনে কাউকে ছাড় দেওয়ার রীতি খুব একটা নেই, এমনটি মনে করা হয়। গত বছরও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গত বছরের ২৬ জুন সমালোচনার মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল। কারণ তিনিও লকডাউনের বিধি ভেঙে তার বান্ধবীকে চুমু দিয়েছিলেন। আর সেটা সিসিটিভি ক্যামেরায় উঠে আসে এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর কেবল তার মন্ত্রিত্বই যায়নি, তার সংসারও ভেঙেছে। লকডাউন ভেঙে সেই একই অপরাধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিসও। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদায় নেওয়ায় তাকেও সেই পথের পথিক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২০ সালে ব্রিটেনে যখন কঠোর লকডাউন চলছিল তখন ২০ মে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং বাসা ১০ নাম্বার ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে একটি মদের পার্টি হয় যাতে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সারা দেশের মানুষ যখন কোভিড বিধিনিষেধ মেনে বাড়িতে বসেছিল, তার মধ্যে আয়োজিত এই পার্টির খবর ফাঁস হওয়ার পর জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া। জনসন গত বুধবার পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে এই ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। পার্টির আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছিল, এতে সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। এই পার্টিতে আগতদের নিজেদের মদ সঙ্গে আনার কথা বলা হয়েছিল। টেবিলে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল নানা রকম খাবার। প্রায় সপ্তাহের মধ্যে এই সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেশ করা হবে বলে মনে করা হয়েছে।

নিজের দলের ভেতর থেকেই জনসনের পদত্যাগের দাবি জোরদার হচ্ছে। বরিস পদত্যাগ করবেন কি না সেটা এখন প্রশ্ন নয়, মূল বিষয় এমপিরা প্রাণান্তকর আলোচনা করছেন কখন, কীভাবে জনসনকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি। এরপর জানা গেল ২০২১ সালেও ডাউনিং স্ট্রিট দুটি মদের পার্টির আয়োজন করেছিল। এর একটি হয়েছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মারা যাওয়ার পর এবং শেষকৃত্যের এক দিন আগে। করোনা বিধিনিষেধ মানতে যেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে রানিকে একাই একটি আসনে বসতে দেখা যায় সেখানে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে রীতিমতো মদের পার্টি হয়েছে এবং সেখানে কোনো সামাজিক দূরত্বও মানা হয়নি। যদিও এজন্য রানির কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘ওয়াইন টাইম ফ্রাইডে’ আয়োজন হয় নিয়মিত। সুটকেসে করে মদ এনে ফ্রিজে রাখা হয়। এসব খবর প্রকাশ হওয়ায় ব্রিটেনের সাধারণ জনগণ, এমনকি শিশুদের কাছেও হাসির পাত্র হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস। ফলে তার ওপর চাপ বেড়েছে বেশ জোরেশোরেই।

ক্ষমতাসীন টোরি বা রক্ষণশীল দলের এমপিরা নেতৃত্বে প্রতিযোগিতায় যাবেন। তারা এক জন নতুন নেতা নির্বাচিত করবেন এবং কোনো নির্বাচন ছাড়াই ঐ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হবেন। ২০১৯ সালে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ার পর এমনটিই ঘটেছিল। নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে রানি এলিজাবেথের কাছে তাকে প্রধানমন্ত্রীর নামের প্রস্তাব যাবে এবং রানি তাতে অনুমোদন দেবেন। প্রধানমন্ত্রী চাইলে আগাম নির্বাচনও দিতে পারেন। তবে ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে পার্লামেন্টের অর্ধেক এমপি যদি সরকারের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেন তাহলে নির্বাচন দিতে হবে। যদিও সেই আইনটি এখন নেই। আর সাধারণত এমপিরা নিজ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা দেয় না।

বরিস জনসন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিদায় নেবেন না। তাকে বাকিংহাম প্যালেসে রানির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। তার উত্তরসূরির নামও দিতে হবে। তবে পার্লামেন্টের আস্থা কে পাবেন তার ওপরই নির্ভর করছে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। বর্তমানে পার্লামেন্টে বরিসের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আছে। ২০১৯ সালে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বরিসও যদি তার উত্তরসূরিকে নির্বাচিত না করে পদত্যাগ করেন তাহলে তাকেও একই কাজ করতে হবে। তবে সরকার কাউকে পছন্দ করতে পারে। এক্ষেত্রে উপ-প্রধানমন্ত্রী ডমিনিক রাব বরিসের উত্তরসূরি বা কিছুদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। বরিস করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে যাওয়ার পর রাবই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। টোরি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক (ভারতীয় বংশোদ্ভূত) এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের নাম শোনা যাচ্ছে। আবার জেরেমি হান্টও এই দৌড়ে চলে আসতে পারেন বলে জানা গেছে। তবে সুনাকের কথা বেশি শোনা যাচ্ছে।

টোরির নেতৃত্ব নির্বাচনেও কিছু নিয়ম আছে। টোরি দলের সার্বিক বিষয়টি দেখভালের জন্য ‘১৯২২ কমিটি’নামের একটি কমিটি আছে। এটাকে দলের এইচআর বিভাগও বলা যেতে পারে। এখানেই দলের নেতারা তাদের সুখ-দুঃখের কথা জানান। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হলে অন্তত ৫৪ জন এমপিকে কমিটির কাছে আবেদন করতে হবে আস্থা ভোটের জন্য। ইতিমধ্যে ২০ এমপি বরিসকে বাদ দিতে কমিটির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এছাড়া স্কটিশ পার্লামেন্টেও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরিসকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *