এইচ বি রিতার গুচ্ছ কবিতা

নাবিক

যে ছুঁয়ে দেখেনি ভূমিতল সমুদ্রতে বুকে ধরে
সে জলকে ভালবাসে কি করে?
দিগন্ত যেখানে মাতা নুইয়ে ছোঁয়নি সমুদ্র নীল জল
অতৃপ্তির ঢেঁকুর তেতো, সেও জানে
স্মৃতিপটে জীবনের ছবি আঁকা বোকা কবি
ফেনিল উর্মিলহরীতে ভাসিয়ে নেয় আঁধার রাত
বিপন্ন শঙ্খচিল কাঁদে, কাঁদুক
তারও কিছু দুঃখশ্লোক লুকানো থাকুক
কিছু কথা নৈঃশব্দ গিলে খায়
কিছু কথা মুক্তির অপেক্ষায়
অথচ তখনো,
সমুদ্র পথের নাবিক জেগে থাকে অনন্ত বালুকাবেলায়।

.

অটামের পাখি

এই যে দেখছো তুমি,
মমিজি মাতসুরি জাপান ছেড়ে আমেরিকার নগ্ন পথে
গাছেদের পাদদেশ স্তূপাকার দৃষ্টিনন্দিত ঝড়া পাতা,
লাল-কমলা-হলুদ-খয়েরী বেশে
এই যে দেখছো তুমি
অটাম কেমন গুটিয়ে নিয়েছে বেলা শীতল রাতের কোলে
এসবই ঘোর লাগা সময়, বয়স পরিক্রমায়।
জলরাশি থেকে ভীষণ দূরে প্রশস্ত একটি নীল আয়না
সেখানে তেত্রিশটি সাদা কালো পাখি উড়ে উড়ে শূন্যে মিশে যায়
আমি অবলোকন করি, একাগ্রচিত্তে
দুটি আঁখি ফুঁলে ফেঁপে উঠে প্রায়শই মধ্যরাতে।
এই যে দেখছো তুমি মুনশাইন মাদকতা মধনিশিতে
এসবই উড়ন্ত পাখির স্থিতি ধারণে আমেরিকার বদান্যতা।
তুমি কি জানো,
এখানে ঘোর লাগা বিষাদ বসন্তী রঙে
হিমঝুরি, গগনশিরীষ কিংবা দেব-কান্চন খোঁপায় গুঁজে না?
যাযাবর পথিকের মত শুভ্র মেঘ নীলাকাশ হেঁটে বেড়ায় না?
এখানে রাতগুলো হয় নক্ষত্রবিহীন, সাদা-মাটা কালো
এমন রাতে চট করে প্রায়ই মাথা ধরে যায়
চুলগুলো হাতের মুঠোয় পেচিয়ে ধরতেই দাঁতে দাঁত চেপে ধরি
দেখি,
তের্রিশটি পাখি তখনো ডানা ঝাপটিয়ে আমেরিকার আকাশে
রংচটা অটামে খুঁজে নেয় সবুজ; শূন্যতাকে বুকে ধারণ করে।

.

শব্দ

শব্দ! আমার কাছে পাশে শুয়ে থাকা প্রেমিকের মত
যখন তখন ইচ্ছে হলেই খেলতে পারি!
চুলে বিলি কেটে, চুল ছিড়ে
শব্দকে ভালবাসি
যন্ত্রনায় কাতর করি
শব্দ আমার কাছে প্রেমিকের মন ভংগার মত
হতাশা পেয়ে বসলেই শব্দকে ক্ষতবিক্ষত করি
সোনা ঝড়া রোদ অধর ছুঁয়ে গেলেই,
সুনীল আকাশের মত বুকে ধারণ করি।

আমি শব্দকে নিয়ে খেলি,
শব্দ আমাকে ভাঙ্গেনা, আমি শব্দকে ভাঙি গড়ি
ইচ্ছেমত
শব্দকে আমার চেতনায় প্রয়োগ করি
গলা চেপে শব্দকে নিজের গভীরে পুঁতে দেই
প্রয়োজনে প্রণয়ে লিপ্ত হই, জবরদস্তি করি
তারপর চৈতন্যের গভীরে ছায়া বিস্তার করে শব্দের বংশ বৃদ্ধি করি।

সবুজ দ্বীপের নিয়ম আমি মানিনা
স্যান্ডল পায়ে কাঁধ বরাবর চটির ব্যাগ, তাতে
নিচক বন্ধি ভাবাবেগ,
দীগন্ত সীমায় একটি পাখী উড়ে যাবার বৃথা অপেক্ষা;
তাও বড় অসহ্য লাগে
শব্দ অন্বেষণে,
এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করার প্রযোজনবোধ করিনা
খালি পা, দুর্গন্ধ পরিধেয় বস্ত্র
আমায় বিচলিত করেনা
হাই ক্লাস, লো ক্লাস
বস্তির খুপড়ি ঘরে, পতিতার নাপাক পেটিকোটের অন্তরালে
আঁশটে ঝং ধরা টিনের থালা
সুশীলের কনডম প্যাকে
মাটির তলদেশে যেখানে চাপা পড়ে আছে হাজারো নক্ষত্র ;
সর্বত্র শব্দ আমাকে খুঁজে নেয় তার সুবিধামত।

আমি শব্দকে দেখিনা
অদৃশ্যের অন্তরালে শব্দকে শুধু ভাঙ্গি-গড়ি, জোড়াতালি দেই
আমার রাত নেই, দুপুর নেই, সকাল নেই
শব্দকে নিয়ে খেলি যখন-তখন,
শব্দ আমাকে যেমন করে চায়।
শব্দ, আমাকে কখনোই ভাবায় না
ধ্বনির মত ক্ষুদ্রতম একক আমি,
উড়নচন্ডী বাতাসে শব্দের তীক্ষ্নতা ও তীব্রতা ছুঁড়ে ফেলে
ধাঁরালো করি মগজ, প্রতিদিন
শব্দের পরিমাপ করিনা, উৎপাদন করি
কেননা, সেরিব্রাল কর্টেক্স আহত হলে
ডেসিবল সেখানে বন্ধ্যা নারী।

.

ঘূর্ণি

অদ্ভূত এক সন্মোহন নিয়ে আজকাল পথে নামি
নেমেই দেখি,
বাতাস নেই কোথাও, একফুটা
তবু দোলল্যমান পৃথিবী জানান দিয়ে যায়;
চরকি ঘুরছে অনবরত।
যেদিকে তাকাই দ্বিধাগ্রস্থ্য শরীর দোলে উঠে
অবারিত সবুজের বুকে সোনালী ধানের ঢেউ
পায়ের নিচে তামাটে মাটি,
পলান্তি খেলে যায় অবিরাম
মনে হয়,
অঘ্রানের শেষ বিকেলে বিষাদগ্রস্থ্য সোনালী রোদ
পুড়িয়ে দেয় রোম
ঝড় নেই তবু,
দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় মেসোপটেমিয় সভ্যতা
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান,
এভাবেই পথে নামি রোজ মোহগ্রস্থ্য শরীর টেনে
মস্তিষ্ক সংযোগে বিফল চেষ্টা শেষে,
অবসাদে শূন্য পা আবারো পালকী চড়ে; অনন্তকাল।

.

রমন্যাস

তুমি বললে, ছুঁয়ে দেখো হাত
বিশ্বাস করো,
এখানে উন্মুক্ত বক্ষ তলে অবারিত সবুজ
নাটাইবিহীন ঘুড়ি
নির্জন দুপুরে ডেকে যায় ঘুঘু
ভালবাসা জেগে থাকে প্রাণে
নক্ষত্রের কানে কানে।
আমি বললাম,
ভেসে যাই তবে
আজ রাতে
নীল জোছনা, না হয়
সাগর জলের ঢেউয়ের তালে।
তুমি বললে,
এসো! এসো আমার প্রাণের খুব কাছে
নিঃসঙ্গ বুকের গান; উড়ে যাক মহূয়ার বনে।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *