সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মা-বাবার ঘুম হারাম

নিউজ ডেস্কঃ রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান রাসেল। দুই ছেলেকে ভর্তির জন্য হাইস্কুলে আবেদন করেন। দুজনই পছন্দের সরকারি স্কুলে অপেক্ষমাণ তালিকায় আছে। আর বেসরকারি স্কুলে চান্স তো দূরের কথা, অপেক্ষমাণ তালিকায়ও নেই।

বড় ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আবেদন করেছিল। তাকে আগের স্কুলে রাখা যাবে। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি-ইচ্ছুক ছোট ছেলেকে নিয়ে তার উদ্বেগের শেষ নেই। এ অবস্থায় কখনো কাঙ্ক্ষিত স্কুলে, আবার কখনো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) তিনি দৌড়াচ্ছেন।

শুধু রাসেল নন-এমন অসংখ্য অভিভাবক সন্তানের ভর্তি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ভর্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে প্রথমবারের মতো এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের বেসরকারি হাইস্কুলে মাউশির তত্ত্বাবধানে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার কেবল জেলা সদর পর্যন্ত স্কুল এই প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে। এ ধরনের ৪৩শ স্কুল থাকলেও এবার অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়ায় এসেছে ২ হাজার ৯৬২টি।

অবশ্য রাজধানীর মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে আগের মতো ভর্তি করাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি স্কুলে গত বছর থেকে এই প্রক্রিয়া চালু আছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ৪০৫টি।

মাউশির তথ্য অনুযায়ী, এবার দুই ধরনের (সরকারি-বেসরকারি) বিদ্যালয়ে সারা দেশে ৯ লাখের বেশি আবেদন পড়ে। এর মধ্যে সরকারিতে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৩ আর বেসরকারিতে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৭ জন।

আবেদনকারী থাকা সত্ত্বেও সরকারি ৪ হাজার ৪৮ আসনে কাউকে নির্বাচন করা যায়নি। এসব বিদ্যালয়ে মোট আসন ৮০ হাজার ১৭টি। আর বেসরকারিতে আসনই আছে ৯ লাখ ৪০ হাজার ৮৭৬টি।

কিন্তু আবেদনকারীদের মধ্যে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪১ জন চান্স পেয়েছে। বাকি শিক্ষার্থীদের কোনো বিদ্যালয় দেওয়া যায়নি। চান্স না পাওয়া এ দুই ধরনের বিদ্যালয়ের আবেদনকারী প্রায় সাড়ে ৫ লাখ।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে-সংকট তাহলে কোথায়? এর জবাবে মাউশির উপপরিচালক ও ভর্তি কমিটির সদস্য সচিব মো. আবদুল আজিজ বলেন, সংকট এক জায়গাতেই রয়েছে-শহরাঞ্চল।

যখন সনাতনী পদ্ধতিতে আবেদন নিয়ে স্কুলভিত্তিক ভর্তি করা হতো, তখনও নামিদামি কিছু স্কুলে ভিড় জমাতেন অভিভাবকরা। এবারও ওইসব স্কুলেই অতিরিক্ত আবেদন পড়েছে। ফলে যারা পর্যাপ্ত আবেদন করেনি, তাদের সবার চাহিদা পূরণ হয়নি।

বিপরীতদিকে শহরের স্কুলে আবেদনকারীরা চান্স না পেয়ে ঘুরলেও মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খরা চলছে ঠিকই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে ৪ হাজার আসন খালি আছে, এর কোনোটিই শহরে নয়।

আর অনলাইন পদ্ধতি প্রমাণ করেছে যে, এত বেসরকারি স্কুল দরকার নেই। কেননা, আসন শূন্য থাকা মানে হচ্ছে-শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি।

রোববার মাউশিতে কথা হয় অভিভাবক মেহেদী হাসান রাসেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কুলগুলোয় ক্যাচমেন্ট ও সাধারণসহ বিভিন্ন কোটায় ভর্তি করা হয়। সবচেয়ে বেশি কোটা ক্যাচমেন্ট এরিয়ার। সংকটও বেশি এই কোটায়।

সাধারণসহ অন্যান্য কোটায় আসন খালি থাকলেও ক্যাচমেন্ট এলাকার শিক্ষার্থীরা অপেক্ষমাণ থাকলেও ভর্তি হতে পারছে না। এ সমস্যার সমাধান জরুরি। কেননা, প্রথম শ্রেণির বাচ্চাদের ভর্তিবিহীন রাখা যাবে না। সরকারকে তাদের জন্য রাস্তা বের করা জরুরি।

অবশ্য বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে আছে বলে জানান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি বিদ্যালয়) ফৌজিয়া জাফরীন। তিনি বলেন, কেউ ভর্তি বঞ্চিত থাকবে না।

যারা আবেদন করেও লটারিতে ভর্তির সুযোগ পায়নি, তারা আসন খালি থাকা স্কুলে সরাসরি গিয়ে ভর্তি হতে পারবে। এমনকি অনলাইনে ভর্তির আবেদন করেনি, তারাও এ সুবিধা পাবে। কোন স্কুলে কত শূন্য আসন আছে, সেই তথ্য মাউশির কাছে চাওয়া হয়েছে।

তালিকা পাওয়ার পর ‘উন্মুক্ত ভর্তি’ শুরু করতে নির্দেশনা দিতে বলা হবে। তখন বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আসন শূন্য থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি নিয়ম মেনে ভর্তি কাজ শেষ করতে পারবে।

বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার প্রথমে বয়সের ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল। অর্থাৎ, প্রথম শ্রেণিতে ৬ থেকে ৭ বছর বয়সিরা ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। বয়স হিসাব করে এ নিয়ম অন্য শ্রেণিতেও বাস্তবায়ন করা হয়।

এমন কয়েকদিন চলায় দুই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। একটি হচ্ছে, কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েও বয়স জটিলতার ফেরে পড়ে ভর্তি হতে পারেনি। তখন আগের প্রতিষ্ঠানেই তারা ভর্তি হয়ে যায়।

আরেকটি হচ্ছে, চান্স পাওয়ার পরও ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় জানা যায়, জামালপুরে একটি স্কুলে কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পরে মাউশি নির্দেশনা জারি করে যে, বয়স শুধু প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে দেখতে হবে।

এ নির্দেশনা দেওয়ার পর প্রথমে যারা আগের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, তারা পরে চান্স পাওয়া অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলে ফের ভর্তি হয়। ফলে দুই জায়গায় ভর্তি হওয়ায় প্রকৃত শূন্য আসন দেখা যাচ্ছে। এ কারণে ক্লাস শুরুর পরে অনেক প্রতিষ্ঠানে শূন্য আসন তৈরি হতে পারে।

রাজধানীর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, উল্লিখিত কারণে কম চাহিদার স্কুলে যেখানে আসন খালি হবে, সেখানে কোন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে, সেই ব্যাপারে মাউশি এখন পর্যন্ত নির্দেশনা দেয়নি।

এতে ওইসব প্রতিষ্ঠানে সংকট তৈরি হবে। কেননা শিক্ষার্থী কম থাকলে প্রতিষ্ঠানের আয়ে প্রভাব পড়বে। এতে শিক্ষকদের বেতনভাতায় প্রভাবিত হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ভর্তি কমিটির এক সদস্য বলেন, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি-ইচ্ছুক যেসব শিক্ষার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পায়নি, তাদের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কেননা, ওইসব প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ভর্তি করাচ্ছে। এছাড়া রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইন কার্যক্রমে আসেনি।

সেগুলোয়ও ভর্তির আবেদন করা যেতে পারে। আর যেখানে পরে আসন শূন্য হবে, সেগুলোর ব্যাপারে পরে নির্দেশনা জারি করা হবে। তবে সরকারিতে শূন্য থাকা ৪ হাজার আসনে ভর্তি কীভাবে করা হবে-এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এগুলো সবই ঢাকার বাইরে।

নীতিমালায় বর্ণিত কমিটির আলোকে সেখানে ভর্তি করাতে হবে। তবে এ ব্যাপারে অভিভাবক আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও মান নিয়ে অভিভাবকদের অসন্তুষ্টি আছে।

সেখানে অনেকেই যেতে চাইবে না। তাই সরকারি-বেসরকারি যেখানে আসন শূন্য আছে বা হবে, সেগুলোর ব্যাপারে মাউশির দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

ফের আলোচনায় রেসিডেন্সিয়াল : ভর্তি নিয়ে এবারও আলোচনায় এসেছে রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ। এক অভিভাবক জানান, প্রতিষ্ঠানটি এবার কেন্দ্রীয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় আসেনি। নিজেরা আবেদন নিয়ে শনিবার তৃতীয় শ্রেণির লটারি আয়োজন করে।

রোববার থেকে শিক্ষার্থীর কাগজপত্র যাচাই করে ভর্তি নেওয়ার কথা। কিন্তু ঘোষণার বাইরে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ভর্তিবঞ্চিত করা হয় অনেককে।

তার সন্তানও আছে ওই তালিকায়। তিনি জানান, তার সন্তানের সোমবার ভর্তির তারিখ ছিল। যাওয়ার পরে ভাইভার নামে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। রাজধানীর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটেনি। এর আগে গত বছর লটারির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *