করোনার ট্যাবলেটকে ‘নাপা’য় পরিণত না করার পরামর্শ

নিউজ ডেস্কঃ করোনা চিকিৎসায় খাওয়ার ট্যাবলেট ‘মলনুপিরাভি’র অনুমোদন দিয়েছে দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।  শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ও বেক্সিমকো ফার্মা এই ওষুধ বাজারে এনেছে। যার জেনেরিক নাম হচ্ছে ‘অ্যামোরিভির’।

এই ওষুধ আবিষ্কারকে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা স্বাগত জানিয়ে বলছেন, এটি করোনা মোকাবিলার জন্য সুখবর। তবে, ট্যাবলেটটি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই সেবন করতে হবে। এটি যেন যেখানে-সেখানে বিক্রি না হয়। কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণ ফার্মেসিকে শর্তসাপেক্ষে বিক্রির অনুমোতি দিতে হবে। এই টেবলেট সহজলভ্যতার সুযোগে ‘নাপা’য় পরিণত না করারও পরামর্শ দেন তারা।

করোনায় খাওয়ার ওষুধ বাজারজাত করার জন্য  ৮ নভেম্বর (সোমবার) দেশে  অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এরপর দিন মঙ্গলবার বিকেল থেকেই এই টেবলেট দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে।

এর আগে,  গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বে ৫০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া করোনার চিকিৎসায় এত দিন অনুমোদিত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ ছিল না। ৪ নভেম্বর এর চিকিৎসায় ‘মলনুপিরাভির’–এর অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য। এ খবর দিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ট্যাবলেট সেবনের ফলে করোনা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। দেশটির স্বাস্থ্য সচিব সাজিদ জাভেদ এই ট্যাবলেটকে গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করেছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক, শার্প অ্যান্ড ডোম (এমএসডি) ও রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিকসের তৈরি করোনার চিকিৎসায় ‘মলনুপিরাভির’ই মুখে খাওয়ার প্রথম ওষুধ। প্রতিদিন দুই বেলা চারটি করে আটটি ট্যাবলেট খেতে হবে। এই ওষুধের কোর্স চলবে পাঁচ দিন। ৮০০ মিলিগ্রামের ‘অ্যামোরিভির’ ওষুধ হলে দিনে দুই বার। পাঁচ দিন খেতে হবে।

মলনুপিরাভির তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি মার্ক ও রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিক যৌথভাবে। ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ১৭টি দেশে। মলনুপিরাভিরের কার্যকারিতা যাচাইয়ে দেখা গেছে, যেসব রোগীর চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতি ও আইনের কারণে অন্য দেশ বা কোম্পানির উদ্ভাবিত ওষুধ তৈরি করতে পারে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এই সুবিধা নিয়েই মার্কের ওষুধ তৈরি করছে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো।

গত মঙ্গলবার দুপুরে এই বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মলনুপিরাভির অ্যান্টিভাইরাল ট্যাবলেট। তবে  টিকার বিকল্প নয়। টিকা নিতে হবে। শুধু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শেই জরুরিভাবে এই ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। কোনোভাবেই ১৮ বছরের নিচের কেউ এই ওষুধ ব্যবহার করতে পারবে না। এই ওষুধ পাঁচ দিনের ডোজ। সকালে চারটা ট্যাবলেট। রাতে চারটা ট্যাবলেট। পাঁচ দিনে মোট চল্লিশটা ট্যাবলেট খেতে হবে।’

মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘করোনার চিকিৎসায় জরুরি ব্যবহারের জন্য অ্যান্টি-ভাইরাল হিসেবে মুখে খাওয়ার ওষুধ মলনুপিরাভিরকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান এই ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করার আবেদন করেছিল। বেক্সিমকো, স্কয়ার ও এসকেএফকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আরও আটটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেগুলো হলো,  স্কয়ার, জেনারেল, বিকন, রেনেটা, ইনসেপটা, একমি, হেলথ কেয়ার ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার চিকিৎসায় এই ওষুধটি দিনে দুই বার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের (ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগ, বাইপাসসহ জটিল রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে) দেওয়া হয়। মূলত এই ওষুধ ফ্লু-এর চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুযায়ী, এই ওষুধ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুঝুঁকি অর্ধেক কমিয়ে দেয়। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় এটাই প্রথম ওষুধ, যেটি শিরায় প্রয়োগ নয় বরং মুখে সেবন করা হবে।’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞা ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মলনুপিরাভির করোনার মুখে খাওয়ার ওষুধ। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য সুখবর। তবে, টিকার বিকল্প ভাবা ঠিক হবে না। যারা আক্রান্ত হবেন, তাদেরই করোনার ওষুধ খেতে হবে। তবে ১৮ বছরের নিচের কাউকে মলনুপিরাভির ওষুধ খাওয়ানো নিষেধ। একইসঙ্গে গর্ভবতী মায়েদের এই ওষুধ সেবন করানো যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই সেবন করতে হবে। একইসঙ্গে সব জায়গায় বিক্রয় না করে সীমিত ফার্মেসিকে শর্তসাপেক্ষে বিক্রির অনুমতি দিতে হবে। এই ওষুধ যেন নাপা না হয়ে যায়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’

মলনুপিরাভির নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘মলনুপিরাভির  কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মলনুপিরাভির ব্যবহারের ফলে মৃত্যু বা হাসপাতালে ভর্তি শতকরা ৫০ ভাগে নামিয়ে আনা সম্ভব। আবারও বলছি ওষুধ মাত্রই যেমন উপকারিতা আছে, তেমনি আছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে। এছাড়া হার্ট অ্যাটাকের রোগীর শরীরে মলনুপিরাভির কী প্রতিক্রিয়া করবে, তা গবেষণার দাবি রাখে।’

এদিকে, বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কভিড আক্রান্ত ৭৭৫ জন রোগীর ওপর মলনুপিরাভিরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়েছে। এতে যা পাওয়া গেছে, তা হলো: যাদের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। যা ১৪ দশমিক ১ শতাংশ রোগীকে দেওয়া সাধারণ পিলের তুলনায় অর্ধেক মলনুপিরাভির দেওয়া হয়েছিল, তাদের কারও মৃত্যু হয়নি। তবে পরীক্ষায় অন্য ওষুধ দেওয়া রোগীদের মধ্যে আটজন কভিডে মারা যান।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এখনো রিভিউ বা পর্যালোচনা করা হয়নি। তবে তথ্য-উপাত্ত থেকে যে বিষয়টি জানা গেছে, সেটি হচ্ছে ওষুধটির কার্যকারিতা পাওয়ার জন্য উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরপরই মলনুপিরাভির সেবন করতে হবে। এর আগে এরইমধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা আশানুরূপ ফল না আসার কারণে স্থগিত করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *