উজান স্রোতে ভেসে যায় 

সাহিত্য ডেস্কঃ ভোরের  স্নান সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মৃত্তিকা। বহুতল ভবনের ছয় তলা বারান্দা। যেন আকাশের কাছাকাছি। আকাশের গায়ে আজ সকালে অনেক নীল ছড়ানো। যেন নীল আকাশ। সকালের মেঘ তো শুভ্রতায় ভরে থাকে। আজ সকালের রঙে এত নীল কেন? কোথায় থেকে এত নীল ভেসে এলো? নিজের মনেই প্রশ্নগুলো ভেসে বেড়ায় মৃত্তিকার। মেঘ যে রকম ভেসে বেড়ায় ঠিক সে রকম। মৃত্তিকা স্নান করে শাদা শাড়ি পরেছে। ব্লাউজটা লাল পরতে যেয়ে আবার কী ভেবে শাদা ব্লাউজ পরলো। মেঘের সঙ্গে হয়তো মিশে যেতে চায়। মেঘটা নীল হওয়ায় মৃত্তিকার মন খারাপ হয়ে খানিকটা গেলো। আচ্ছা ব্লাউজটা নীল হলে কেমন হতো! শাদার সঙ্গে নীলও তো ভালো লাগতো। নীল মেঘের সঙ্গে মিলে যেতো। ভাবনাতেই থেকে গেলো নীল ব্লাউজ। পরা হলো না। তখনো তার পিঠের ওপর ভেজা চুল ছেড়ে দেওয়া একটু একটু পানি চুয়ে তখনো ব্লাউজটা শিশিরে দাগের মতো ভিজে দিচ্ছে। আচ্ছা রাজন এমন করে আদর দিয়ে আমাকে একটু একটু করে ভিজিয়ে দিতে পারে না! আবার ভাবে, ও আমার কে! ও আমাকে আদর করে ভেজাবে কেন! কী যে ঝরাপাতার মতো প্রাণহীন ভাবনা।

ভোরের স্নানের পানি তখনো মৃত্তিকাকে আদর বুনছে। একমুঠো মিষ্টি রোদ্দুর তখন মৃত্তিকার চোখে মুখে আভা ছড়াচ্ছে। ভেজাচুলের পুরোটা ছেড়ে দিয়ে মিষ্টি রোদে যেন পিঠ পেতে দেয়। এমন সুন্দর লাবণ্য পিঠ রোদের মতো করে আর কে কবে পেয়েছে! রাজনের পুরো পছন্দের যে মৃত্তিকা; সেই কী কখনো দেখেছে মৃত্তিকার পিঠের এমন উজ্জ্বলতা! এমন লাবণ্য সুন্দরতা! পৃথিবীর সব রূপ যেন মৃত্তিকা শরীরে। কেউ দেখেনি এ রূপ; এ লাবণ্য। রোদের সঙ্গে যেনো রাজনের হিংসের আগুন-খেলা। রোদকে তার ভীষণ হিংসে হয়। আচ্ছা মৃত্তিকা রোদকে অমন সুন্দর করে পিঠের লাবণ্য পেতে দেয়, রাজনকে দেয় না কেন! রোদ কী রাজনের চেয়ে বেশি প্রিয়! রাজনের রোদ হতে ইচ্ছে করে; ভোরের কাঁচামিষ্টি রোদ; যে রোদ মৃত্তিকার লাবণ্য পান করে মন ভরে; রাজনেরও অমন করে পান করতে ইচ্ছে করে।

মৃত্তিকা সারাদিন কোথায় কোথায় যে পাগলের মতো হাঁটে। কেন হাঁটে জানে না। কিন্তু মনের ভেতর রাজনকে নিয়েই হাঁটে। রাজনের জন্যেই যেন সে এলোমেলো। এলোমেলো হাঁটা। এলোমেলো জীবন পা-টা যে ব্যথায় ফুলে উঠেছে;  তাও ভুলে গেছে। রাজন মনের ভেতর থাকলে সব ভুলে যায় মৃত্তিকা। কিন্তু ব্যথাটা যখন প্রবল হয়ে ওঠে; তখনো যেন ব্যথা প্রশমনের জন্যে রাজনের নামই বলে ওঠে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। ব্যথাটা যেন বাড়ছেই। রাজনের জন্যে সবসময় তো মনের ব্যথা আছেই। আর এখন আবার পায়ে ব্যথা। পা-টা বেশ কেটেও গেছে। এও তো রাজনের জন্যেই। ওকে বুকের ভেতর নিয়ে; ওকে খুঁজে খুঁজে কোথায় যে কোন অচিন পথে হাঁটি! রাজন কী বুঝতে পারে; আমি ওর  পাগলি!

রাজন যেন প্রজাপতি হয়ে উড়ে আসে মৃত্তিকার ব্যথাতুর পায়ে। পায়ের ক্ষত জায়গায় চুমুতে চুমুতে ব্যথাটা নিজের ভেতর শুষে নেয়। মৃত্তিকা লজ্জা পায়। মনে মনে সলজ্জ আভায বলে, ‘প্রজাপতি! ও প্রজাপতি! তুমি কী সত্যি প্রজাপতি! আমি জানি তুমি কে! না না তুমি আমার প্রজাপতি হয়েই থাকো!’ প্রজাপতিটা মৃত্তিকার পায়ে চুমু দিয়ে ব্যথা শুষে নেয়! মৃত্তিকার ভালোও লাগে। আবার একটু একটু মধুর লজ্জায় জড়িয়েও যায়। মনে মনে বলে; এই প্রজাপতি আরও বেশি করে চুমু দাও; এখনো তো অনেক ব্যথা! চুমুর আদরে তার লাল পা আরো লাল করে দেয় প্রজাপতি। লজ্জার আভা যেন সবটুকু ছড়িয়ে । প্রজাপতিকে পা থেকে আদর করে বুকের ভেতর টেনে নেয় মৃত্তিকা। প্রজাপতিকে আদর করে মনে মনে বলে, এই যে তোমাকে আমি বুকের ভেতর নিয়ে এত আদর করছি, তুমি আমার কে! কী হও! কী সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার! তুমি কী আমাকে বিয়ে করেছ! আমি কী তোমার লাল টুকটুকে ছোট্ট পরীবউ! কোনো উত্তর পায় না মৃত্তিকা। আবার নিজেকেই নিজে মনে মনে প্রশ্ন করে, আমার পায়ে তুমি অত চুমু খাও কেন! আমার ব্যথা তুমি নেবে কেন!  আমার পায়ে ব্যথা সে তো আমার ব্যথা । আমার ব্যথা আমি সহ্য করবো। তুমি কেন ব্যথা শুষে নিতে আসো! কোনো উত্তর পায় না মৃত্তিকা।

রাজনের কাছেও কোনো উত্তর নেই। কিন্তু সবকিছু ভেতর থেকেও মৃত্তিকা আর রাজন যে দুজন দুজনের একান্ত আপন; ছোট্ট পৃথিবী; কোন্ নিয়ম দিয়ে; কোন্ সম্পর্ক দিয়ে তা নির্ণিত হবে! দুজনের কেউই জানে না। শুধু জানে দুজন কোথাও কোনোভাবে এক জীবনে বাঁধা হয়ে গেছে; দুজনে এক জীবনে জীবন হয়ে উঠেছে; যেন একটুকরো মাটি; দুটো ভাগ শুধু।

আবার এরকমও মৃত্তিকা ভাবে; রাজন হলো মাটি। আমি বৃষ্টি। আমি মাটিকে ভিজিয়ে তার ভেতর নিজে বিলীন হই। রাজনকে নিজের ভেতর বিলিন করে একাত্ম করে নেয় মৃত্তিকা। দুটি শরীর তখন এক হয়ে ওঠে; আলাদা কোনো সত্তা থাকে না। আলাদা শরীর থাকে না। আলাদা মন থাকে না;  আলাদা করে কিছু চাওয়া বা পাওয়া থাকে না। আলাদা কোনো জীবনও থাকে না। তাহলে তা কী বৃষ্টিতে মাটির একাত্ম হয়ে বিলিন হওয়া গভীর সঙ্গমের মতো একাত্ম হওয়া! সঙ্গমেও তো চাওয়া থাকে; পাওয়া থাকে; রুচির পাপড়ি থাকে; শৈল্পিকতা থাকে; তৃপ্তি অতৃপ্তির বিষয় থাকে। মৃত্তিকা আর রাজনের একাত্মতার ভেতর ও রকম কী কিছু আছে! মৃত্তিকা তা তো ভুল করেও কখনো ভাবেনি। রাজনও না। কিন্তু ওরা দুজনে একাত্ম হয় বৃষ্টি ও মাটির মতো;  চোখ আর মনের মুগ্ধতায়; শরীর যেন ওদের কাছে কবিতার মতো অন্তঃসৌন্দর্য্য;  যেন অপার্থিব অধরাশিল্প।

রাজন দুচোখ ভরে মৃত্তিকাকে দেখে। কী সুন্দর তার হাসি। কী সুন্দর করে হাঁটে। কবিতার মতো কী চমৎকার করে কথা বলে। খুব মিষ্টি একটি চেহারা। হীরকদ্যুতির মতো লাবণ্য যেন সারা শরীরে ফুটে থাকে। রাজনের সব পছন্দ সব ভালো লাগা যেন মৃত্তিকার আপাদমস্তক জড়ানো। রাজন দুচোখ ভরে তাকে দেখে। মন ভরে তাকে দেখে। মুগ্ধতায় বুক ভরে নেয়। রাজন ভাবে;  একজনের পছন্দের সবটুকু নিয়ে অন্য আর একজন মানুষ কিভাবে হয়! কিন্তু বাস্তবে যে হয়; তাও তো সত্য; মৃত্তিকাকে না দেখলে তা বিশ্বাস হতো না রাজনের। কিন্তু রাজন জানে; ভালো করেই জানেই মৃত্তিকাকে তার পাওয়া হবে না। যদি এই সত্যই রাজনকে বুকের ফ্রেমে সত্য বলে বেঁধে রাখতে হয়, তাহলে রাজন এ নগরে কেন থাকবে! কার জন্যে থাকবে! কোন স্বপ্ন তাকে এখানে ধরে রাখবে! সকালের রোদ যেমন সকালের পর সকালের মতো মিষ্টি-মায়াবি থাকে না, দুপুরের রোদ যেমন দুপুরের পর পাগলা অবাধ্য যৌবনের মতো থাকে না, বিকেলের শান্ত রোদ যেমন সন্ধ্যায় মরে যায়; একদিন এভাবেই তো রাজন মরে যাবে মৃত্তিকার কাছে। কিংবা রাজনের কাছে মৃত্তিকা। ভেতরে থাকবে স্মৃতির যন্ত্রণা, স্মৃতির বেদনা। রাজন ভাবে, স্পর্ধার আগুনে সব ভেঙেচুরে নতুন করে মৃত্তিকাকে জীবনে আনতে হবে, অথবা সরে যেতে হবে তার জীবন থেকে হাজার মাইল দূরে। কিন্তু রাজন ইচ্ছে করলেই কী সব পারে! পারবে! কতটা পারাই বা যুক্তিযুক্ত! হিসেবের অঙ্ক মেলাতে গেলে কিছুই হবে না; বড়জোর বন্ধ্যানদী কিংবা নপুংশক-জীবন। রাজনের হিসেবে কোনো হিসেবেই আসে না। যেন সে নিজেই এক অন্ধকার জীবনসড়ক।

রাজন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যেন জীবনযুদ্ধে আহত ও ক্লান্ত এক পাখি। এ নগর থেকে ফিরে যাবার জন্যে ভাবে। কোথায় যাবে; কতদূর যাবে; রাজন নিজেও জানে না। শুধু ভাবে এ নগর থেকে চলে যাবে; মৃত্তিকার জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু কেন এই ভাবনা! মৃত্তিকা তো তাকে কোনো কিছুতেই ফিরিয়ে দেয়নি। বুকের কোমল ভূমিতে সে তো রাজনকেই বপন করে লালন করে রেখেছে। তাহলে রাজন কেন ফিরে যাবে;  কেন ফিরে যেতে হবে তাকে! তারপরও রাজন ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হয়। সে চায় না তার জন্যে মৃত্তিকার কুসুমসুন্দর জীবন ছন্দহীন হয়ে যাক! পাগলা বৈশাখে ভেঙে যাক তার স্বপ্নসৌধমন্দির। নিজের থেকেই নিজেকে সরিয়ে উত্তরহীনভাবে সে চলে যেতে চায়। শুধু ভাবে, মৃত্তিকার সঙ্গে শেষ দেখা হলে ভালো হতো; দুদণ্ড শান্তি নিয়ে ফিরে যেতে পারতো। পৃথিবীর সব ইচ্ছে তো সবার পূরণ হয় না। রাজনও তা জানে। এ শহরকে বৃষ্টিচোখে বিদায় জানায় সে।

মন খারাপ করে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকে রাজন। আপাতত গ্রামে ফিরে যাবে সে। যেখানে একদিন কাদামাটি গায়ে রাজন জন্মেছিলো। বেড়ে উঠেছিলো। সেই কাদামাটি গায়ে এ শহরে এতোগুলো বছর থেকে গেলো; কেউ তার বুকের গভীর ক্রন্দন দেখেনি; কেউ জানেনি কিভাবে লোকটি ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল; কেউ শোনেনি নিশুতি রাতে তার অব্যক্ত গোঙানি শব্দ; রাজপ্রাসাদের মতো ঝলমলে এ নগরে লোকটি কতদিন পুড়েছে ভাতের আগুনে; কেউ জিজ্ঞেস করেনি;  কোনোদিন কোন নারী কী প্রেমের লাল গোলাপ পাপড়ির মতো স্নিগ্ধ হাত রেখেছিল তার মাথায়; তার চোখের দিকে কাঁচাচরের মতো নরোম চোখ রেখে কেউ কী বলেছিলো ভালোবাসি; রাজন এসব মনে করতে চায় না। সে তো জানে তার জীবন থেকে সত্যিকারের জীবনের বাকল কিভাবে খসে গেছে;  কত বেদনায় কতভাবে পুড়েছে জীবনভর; একটু  স্নেহের জন্যে কিভাবে কাঙালের মতো খুঁজেছে একটুকরো মৃত্তিকা;  কে কবে নিজেকে সাজিয়েছে তার পছন্দের রঙে; তার পছন্দের বা ইচ্ছের কী মূল্য আছে এ পৃথিবীতে; কেন অনর্থক এই বেঁচে থাকা! এই বাঁচা দিয়ে পৃথিবীর কার কী যায় আসে! আবার এ প্রশ্নও তৈরি হয় রাজনের; মৃত্তিকা আমাকে এতো বোঝে কিভাবে! আমার সব ইচ্ছের মতো হয়ে ওঠে কিভাবে সে! আমার সব অপূর্ণতা ও কেন পূর্ণতা দিতে চায়! মৃত্তিকা আমার কে! সেলুলয়েডের ফিতার মতো করে যেন প্রশ্নগুলো রাজনের মনের ভেতর ভেসে ওঠে।

রাজন ভালো করে শহরটাকে দেখে নেয়; বড় করে একবার নিঃশ্বাস নিতে চায়; কিন্তু এ নিঃশ্বাসে আজ এতো বিষ কেন! তার বুক ভেঙে আসছে কেন! সে কী এখন মরে যাবে! বুকের ভেতর এত কষ্ট কেন! এ কী মরণ কষ্ট! মৃত্তিকাকে রেখে চলে যেতে তার এত মরণ যন্ত্রণা কেন! মৃত্তিকা কী জানে সে চলে যাচ্ছে! সে চলে যাওয়ার পর মৃত্তিকা কেমন করে থাকবে তা কী রাজন একবারও ভেবেছে! রাজনের চলে যাওয়ার পর মৃত্তিকার নিঃশ্বাস ঠিকমতো বেরুবে কি না তা কি রাজন নিজেকে কখনো জিজ্ঞেস করেছে? না, রাজন এসব কিছুই ভাবেনি। শুধু ভেবেছে তাকে চলে যেতে হবে; তার কাদামাটি গ্রামে; যেখানে আর একবার বুক পেতে দিয়ে মন ভরে ঘুমোতে চায়;  যে ঘুম বহুবছর তাকে কেউ দিতে পারেনি। আচ্ছা মৃত্তিকার কোলের ওপর মাথা রেখে সে তো কতবার ঘুমোতে চেয়েছে; পাখির পালকের মমতার মতো করে তখন আদর করতে পারতো মৃত্তিকা। অমন করে ঘুমোনো হয়নি কেন তার! কেন তার ভেজা চোখে শাড়ির আঁচল মমতার ছোঁয়া হয়ে ফুটে ওঠেনি! কেনো মধ্যরাতে পুষ্পিতা শাড়ির ভাঁজ সে আদর করে ভাঙতে পারেনি! যৌবন কেন উজানস্রোতে ভেসে যায়! রাজন এসব প্রশ্ন বাতাসে কর্পূরের মতো উড়িয়ে দিয়ে একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয় বুকের ভেতর। নিঃশ্বাসে যে এতটা বিষ টেনে নিতে হয়; এর আগে রাজন বোঝেনি কখনো।

মৃত্তিকার থেকে তিথি তার মনের কোণে প্রবল শক্তি হয়ে ওঠে। নদীর অবাধ্য স্রোতের মতো রাজনকে টান দেয়। নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো রাজন ভাঙে, ভেঙে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *