প্যান্ডোরা পেপারস কেলেঙ্কারি : জনসন ও ইমরানের গদিতে টান পড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ সাড়া জাগানো প্যান্ডোরা পেপারস কেলেঙ্কারি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। রাজা-বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সেলিব্রেটিসহ গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যক্তিরা তথ্য গোপন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং অবৈধ লেনদেনে যুক্ত রয়েছেন, তাদের নিয়ে গতকাল থেকে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কর্তৃত্ববাদী রাশিয়া, আজারবাইজান, চেক প্রজাতন্ত্র ও রাজতান্ত্রিক জর্ডানের রাষ্ট্রপ্রধানদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে কথা হলেও সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন গণতান্ত্রিক দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। সরাসরি দুর্নীতির দায় না থাকলেও দলীয় তহবিলে অনৈতিক লেনদেনের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মন্ত্রিসভার সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গদিতেই টান পড়া শুরু হয়েছে।

খবর বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, এনডিটিভি ও দ্য ডনের।

গত রোববার ইন্টারন্যাশনাল করসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) প্যান্ডোরা পেপারস প্রকাশ করে। আইসিআইজের ফাঁস করা নথিতে দেখা গেছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছের মানুষরাই অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে লাখ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। এ তালিকায় সবচেয়ে আলোচিত নাম দেশটির অর্থমন্ত্রী ও ইমরান খানের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত শওকত তারিন এবং তার পরিবারের সদস্যরা। শিল্প ও উৎপাদনমন্ত্রী খোশরো বখতিয়ারের পরিবারও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আছেন। আরও আছেন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য ফয়সাল ওয়াদা, ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের শীর্ষস্থানীয় দাতা আরিফ নকভি, দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আবদুল আলিম খান এবং ইমরান খানের সাবেক অর্থ ও রাজস্ববিষয়ক উপদেষ্টা ওয়াকার মাসুদ খানের ছেলে।

আরিফ নকভির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রতারণার মামলা চলছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনে আরিফ নকভি ছিলেন ইমরান খানের পৃষ্ঠপোষক এবং তহবিল জোগানদাতা। প্যান্ডোরা পেপারসে বেশ কয়েকটি অফশোর কোম্পানিতে তার বিনিয়োগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন এবং তার পরিবারের সদস্যরা অন্তত চারটি অফশোর কোম্পানির মালিক। যদিও গতকাল এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে শওকত তারিন বলেছেন, যে অফশোর কোম্পানিগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো তার ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহের জন্য গঠন করা হয়েছিল।

রাজনীতিক, সাংবাদিক, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাসহ সাত শতাধিক পাকিস্তানির নাম প্যান্ডোরা পেপারসে এলেও ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছেন ইমরান খান। কারণ এর আগে প্যারাডাইস ও পানামা কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে পানামা পেপারসের দুর্নীতির তথ্যকে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার সরকারকে কোনঠাসা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই মামলায় ক্ষমতা হারান নওয়াজ। উত্থান হয় ইমরান খানের। সে সময় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ইমরান খান। তবে এবার প্যান্ডোরা পেপারসে দেখা যাচ্ছে, তার চারপাশেই ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতিবাজ ও সম্পদ গোপনকারীরা সুবিধাজনক জায়গায় বসে আছেন। ফলে বিষয়টি ইমরান খানের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের সাধারণ সম্পাদক আহসান ইকবাল গতকাল সোমবার ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে প্যান্ডোরা পেপারস নিয়ে ইমরান খানকে একহাত নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের পদত্যাগ দাবি করেছেন তিনি। আহসান ইকবাল বলেন, প্যান্ডোরা পেপারসে নাম এসেছে প্রধানমন্ত্রীর। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন তিনি।

তবে গতকাল একাধিক টুইটে ইমরান খান প্যান্ডোরা পেপারসের বিষয়ে তার অবস্থান পরিস্কার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করবেন তিনি।

এদিকে প্যান্ডোরা পেপারস নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও ব্যাপক চাপে পড়েছেন। জনসনের ঘনিষ্ঠ ও শীর্ষস্থানীয় দাতা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমেরসি অবৈধভাবে নির্বাচনের সময় দলীয় তহবিলে চাঁদা দিয়েছিলেন বলে প্যান্ডোরা পেপারসে উঠে এসেছে। তার বিরুদ্ধে ২২০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এমন একজন দুর্নীতিবাজের কাছ থেকে দলীয় তহবিলে অর্থ নেওয়ায় গতকাল জনসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধী দল লেবার পার্টি ও অন্য দলের নেতারা।

এ বিষয়ে গতকাল লেবার নেতা অ্যানেলিয়েসি বলেছেন, ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির হোতার (আমেরসি) কাছ থেকে হাজার হাজার পাউন্ড নিয়েছেন কনজারভেটিভরা, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার শর্তে এই বিপুল অর্থ নেওয়া হয়েছে। এই অর্থ ফেরত দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার গতকাল দলীয় সম্মেলনে জনসন বলেছেন, সব নিয়ম নেমে স্বাভাবিকভাবেই দাতাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। তবে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমেরসির কাছ থেকে নেওয়া অর্থের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন তিনি। এ বিষয়ে লেবার এমপি মার্গারেট হজ বলেছেন, কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাজ্য। নোংরা অর্থের পথ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে আমাদের অফশোর কোম্পানিগুলো। এটি যুক্তরাজ্যের জন্য লজ্জাজনক।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমও প্রধানমন্ত্রী জনসনকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় তুলেছে। এখন দেখার বিষয় পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়। গণতান্ত্রিক ব্রিটেনে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় টিকে থাকা কতটা সম্ভব, তা সময়ই বলে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *